ইহা চৌতালও নহে, একতালাও নহে, ধামারও নয়, ঝাঁপতালও নয়। লয়ের হিসাব দিলেও তালের হিসাব মেলে না। তালওয়ালা সেই গরমিল লইয়া কবিকে দায়িক করে।
কিন্তু, হাল আমলে এ সমস্ত উৎপাত চলিবে না। আমরা শাসন মানিব, তাই বলিয়া অত্যাচার মানিব না। কেননা, যে-নিয়ম সত্য সে-নিয়ম বাহিরের জিনিস নয়, তাহা বিশ্বের বলিয়াই তাহা আমার আপনার। যে-নিয়ম ওস্তাদের তাহা আমার ভিতরে নাই, বাহিরে আছে; সুতরাং তাকে অভ্যাস করিয়া বা ভয় করিয়া বা দায়ে পড়িয়া মানিতে হয়। এইরূপ মানার দ্বারাই শক্তির বিকাশ বন্ধ হইয়া যায়। আমাদের সংগীতকে এই মানা হইতে মুক্তি দিলে তবেই তার স্বভাব তার স্বরূপকে নব নব উদ্ভাইবনার ভিতর দিয়া ব্যক্ত করিতে থাকিবে।
সংস্কৃত-বাংলা এবং প্রাকৃত-বাংলার গতিভঙ্গিতে একটা লয়ের তফাত আছে। তার প্রকৃত কারণ প্রাকৃত-বাংলার দেহতত্ত্বটা হসন্তের ছাঁচে, সংস্কৃত-বাংলার হলন্তের।১ অর্থাৎ, উভয়ের ধ্বনিস্বভাবটা পরস্পরের উলটো। প্রাকৃত-বাংলা স্বরবর্ণের মধ্যস্থতা থেকে মুক্ত হয়ে পদে পদে তার ব্যঞ্জনধ্বনিগুলোকে আঁট করে তোলে। সুতরাং তার ছন্দের বুনানি সমতল নয়, তা তরঙ্গিত। সোজা লাইনের সুতো ধরে বিশেষ কোনো প্রাকৃত-বাংলার ছন্দকে মাপলে হয়তো বিশেষ কোনো সংস্কৃত-বাংলার ছন্দের সঙ্গে সে বহরে সমান হতে পারে, কিন্তু সুতোর মাপকে কি আদর্শ বলে ধরা যায়।
মনে করা যাক, রাজমিস্ত্রি দেয়াল বানাচ্ছে; ওলনদণ্ড ঝুলিয়ে দেখা গেল, সেটা হল বারো ফিট। কিন্তু, মোটের উপর দেয়াল খাড়া দাঁড়িয়ে থাকলেও সেটার উপরিতল যদি ঢেউখেলানো হয়, তবে কারুবিচারে সেই তরঙ্গিত ভঙ্গিটাই বিশেষ আখ্যা পেয়ে থাকে। দৃষ্টান্তের সাহায্য নেওয়া যাক।
‘ বউ কথা কও, বউ কথা কও '
যতই গায় সে পাখি,
নিজের কথাই কুঞ্জবনের
সব কথা দেয় ঢাকি।
খাড়া সুতোর মাপে দাঁড়ায় এই–
১ | ২ | ১ | ২। | ১ | ২ | ১ | ২ |
বউ | ক। | ধা | কও। | ক। | থা | ক | কও |
১ | ২ | ১ | ২ | ১ | ২ | ||
য | তই। | গায় | সে। | পা | খি, | ||
১ | ২ | ১ | ২ | ১ | ২ | ১ | ২ |
নি | জের। | ক | থাই। | কুন্ | জ। | ব | নের |
১ | ২ | ১ | ২ | ১ | ২ | ||
সব | ক। | থা | দেয়। | ঢা | কি |
১ ‘হলন্ত’ শব্দ স্বরান্ত অর্থে প্রযুক্ত।