দইওআলা। কিচ্ছু দেরি হয় নি বাবা, আমার কোনো লোকসান হয় নি। দই বেচতে যে কত সুখ সে তোমার কাছে শিখে নিলুম।
[ প্রস্থান
অমল। (সুর করিয়া), দই, দই, দই, ভালো দই! সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শামলী নদীর ধারে গয়লাদের বাড়ির দই। তারা ভোরের বেলায় গাছের তলায় গোরু দাঁড় করিয়ে দুধ দোয়, সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা দই পাতে, সেই দই। দই, দই, দই —ই, ভালো দই! এই-যে রাস্তায় প্রহরী পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। প্রহরী, প্রহরী, একটিবার শুনে যাওনা প্রহরী!
প্রহরী। অমন করে ডাকাডাকি করছ কেন? আমাকে ভয় কর না তুমি?
অমল। কেন, তোমাকে কেন ভয় করব?
প্রহরী। যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যাই।
অমল। কোথায় ধরে নিয়ে যাবে? অনেক দূরে? ঐ পাহাড় পেরিয়ে?
প্রহরী। একেবারে রাজার কাছে যদি নিয়ে যাই।
অমল। রাজার কাছে? নিয়ে যাও-না আমাকে। কিন্তু আমাকে যে করিরাজ বাইরে যেতে বারণ করেছে। আমাকে কেউ কোত্থাও ধরে নিয়ে যেতে পারবে না —আমাকে কেবল দিনরাত্রি এখানেই বসে থাকতে হবে।
প্রহরী। কবিরাজ বারণ করেছে? আহা, তাই বটে —তোমার মুখ যেন সাদা হয়ে গেছে। চোখের কোলে কালি পড়েছে। তোমার হাত দুখানিতে শিরগুলি দেখা যাচ্ছে।
অমল। তুমি ঘণ্টা বাজাবে না প্রহরী?
প্রহরী। এখনো সময় হয় নি।
অমল। কেউ বলে ‘সময় বয়ে যাচ্ছে’, কেউ বলে ‘সময় হয় নি’। আচ্ছা, তুমি ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেই তো সময় হবে?
প্রহরী। সে কি হয়! সময় হলে তবে আমি ঘণ্টা বাজিয়ে দিই।
অমল। বেশ লাগে তোমার ঘণ্টা— আমার শুনতে ভারি ভালো লাগে— দুপুরবেলা আমাদের বাড়িতে যখন সকলেরই খাওয়া হয়ে যায়— পিসেমশায় কোথায় কাজ করতে বেরিয়ে যান, পিসিমা রামায়ণ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েন, আমাদের খুদে কুকুরটা উঠোনে ঐ কোণের ছায়ায় লেজের মধ্যে মুখ গুঁজে ঘুমোতে থাকে – তখন তোমার ঐ ঘণ্টা বাজে – ঢং ঢং ঢং, ঢং ঢং ঢং। তোমার ঘণ্টা কেন বাজে?
প্রহরী। ঘণ্টা এই কথা সবাইকে বলে, সময় বসে নেই, সময় কেবলই চলে যাচ্ছে।
অমল। কোথায় চলে যাচ্ছে? কোন্ দেশে?
প্রহরী। সে কথা কেউ জানে না।
অমল। সে দেশ বুঝি কেউ দেখে আসে নি? আমার ভারি ইচ্ছে করছে ঐ সময়ের সঙ্গে চলে যাই —যে দেশের কথা কেউ জানে না সেই অনেক দূরে।
প্রহরী। সে দেশে সবাইকে যেতে হবে বাবা!
অমল। আমাকেও যেতে হবে?