বৈকুণ্ঠ। হা হা হা হা! আপনি বেশ কথাগুলি বলেন।
কেদার। কিন্তু হাসির কথা নয় বৈকুণ্ঠবাবু, ওর নাম কী, আপনার লেখার স্থানে স্থানে যথার্থই রোমাঞ্চ হয়—তা, কী বলে, আপনার মুখের সামনেই বললুম।
বৈকুণ্ঠ। বুঝেছি আপনি কোন্ জায়গার কথা বলছেন, সেখানটা লেখার সময় আমারই চোখে জল এসেছিল। যদি আপনার বিরক্তি বোধ না হয় তো সেই জায়গাটা একবার পড়ে শোনাই।
কেদার। বিরক্তি! বিলক্ষণ! ওর নাম কী, আমি আপনাকে ঐ জায়গাটা পড়বার জন্যে অনুরোধ করতে যাচ্ছিলুম। (স্বগত) শ্যালীটিকে পার করা পর্যন্ত হে ভগবান, আমাকে ধৈর্য দাও— তার পরে আমারও একদিন আসবে!
বৈকুণ্ঠ। কী বলছেন কেদারবাবু?
কেদার। বলছিলুম যে, ওর নাম কী, সাহিত্যের কামড় কচ্ছপের কামড়— যাকে একবার ধরে, ওর নাম কী, তাকে সহজে ছাড়তে চায় না। আহা, অমন জিনিস কি আর আছে?
বৈকুণ্ঠ। হা হা হা হা! কচ্ছপের কামড়! আপনার কথাগুলি বড়ো চমৎকার। —এই যে সেই জায়গাটা। তবে শুনুন।—হে ভারতভূমি, এক সময়ে তুমি প্রবীণ বীর্যবান পুরুষদিগের তপোভূমি ছিলে; তখন রাজার রাজত্বও তপস্যা ছিল, কবির কবিত্বও তপস্যারই নামান্তর ছিল। তখন তাপস জনক রাজ্যশাসন করিতেন, তখন তাপস বাল্মীকি রামায়ণগানে তপঃপ্রভাব উৎসারিত করিয়া দিতেন; তখন সকল জ্ঞান, সকল বিদ্যা, সংসারের সকল কর্তব্য, জীবনের সকল আনন্দ সাধনার সামগ্রী ছিল। তখন গৃহাশ্রমও আশ্রম ছিল, অরণ্যাশ্রমও আশ্রম ছিল। আজ যে কুলত্যাগিনী সংগীতবিদ্যা নাট্যশালায় বিদেশী বংশীর কাংস্যকণ্ঠে আর্তনাদ করিতেছে, প্রমোদালয়ে সুরাসরোবরে স্খলিতচরণে আত্মহত্যা করিয়া মরিতেছে, সেই সংগীত একদিন ভরতমুনীর তপোবলে মূর্তিমান হইয়া স্বর্গকে স্বর্গীয় করিয়া তুলিয়াছিল; সেই সংগীত সাধকশ্রেষ্ঠ নারদের বীণাতন্ত্রী হইতে শুভ্ররশ্মিরাশির ন্যায় বিচ্ছুরিত হইয়া বৈকুণ্ঠধিপতির বিগলিত পাদপদ্মনিস্যন্দিত পুণ্য নির্ঝরিণীকে ম্লান মর্ত্যলোকে প্রবাহিত করিয়াছিল। হে দুর্ভাগিনী ভারতভূমি, আজ তুমি কৃশকায় দীনপ্রাণ রোগজীর্ণ শিশুদিগের ক্রীড়াভূমি; আজ তোমার যজ্ঞবেদীর পুণ্য মৃত্তিকা লইয়া অবোধগণ পুত্তলিকা নির্মাণ করিতেছে; আজ সাধনাও নাই, সিদ্ধিও নাই; আজ বিদ্যার স্থলে বাচালতা, বীর্যের স্থলে অহংকার এবং তপস্যার স্থলে চাতুরী বিরাজ করিতেছে। যে বজ্রবক্ষ বিপুল তরণী একদিন উত্তাল তরঙ্গ ভেদ করিয়া মহাসমুদ্র পার হইত, আজ সে তরণীর কর্ণধার নাই; আমরা কয়েকজন বালকে তাহারই কয়েক খণ্ড জীর্ণ কাষ্ঠ লইয়া ভেলা বাঁধিয়া আমাদের পল্লীপ্রান্তের পঙ্কপল্বলে ক্রীড়া করিতেছি এবং শিশুসুলভ মোহে অজ্ঞানসুলভ অহংকার কল্পনা করিতেছি, এই ভগ্ন ভেলাই সেই অর্ণবতরী,আমরাই সেই আর্য,এবং আমাদের গ্রামের এই জীর্ণপত্রকলুষিত জলকুণ্ডই সেই অতলম্পর্শ সাধনসমুদ্র।
ঈশান। বাবু, খাবার এসেছে।
বৈকুণ্ঠ। তাঁকে একটু বসতে বলো।
ঈশান। বসতে বলব কাকে? খাবার এসেছে।
কেদার। তা হলে আমি উঠি। ওর নাম কী, স্বার্থপর হয়ে আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি—
বৈকুণ্ঠ। কেন, আপনি উঠছেন কেন?
ঈশান। নাঃ, ওঁর আর উঠে কাজ নেই! তামাম রাত ধরে তোমার ঐ লেখা শুনুন! (কেদারের প্রতি) যাও বাবু, তুমি ঘরে