
সৌন্দর্যে ও মঙ্গলে যে জায়গায় মিল আছে সে জায়গাটা বিচার করিয়া দেখা যাক। আমরা প্রথমে দেখাইয়াছি, সৌন্দর্য প্রয়োজনের বাড়া। এইজন্য তাহাকে আমরা ঐশ্বর্য বলিয়া মানি। এইজন্য তাহা আমাদিগকে নিছক স্বার্থসাধনের দারিদ্র্য হইতে প্রেমের মধ্যে মুক্তি দেয়।
মঙ্গলের মধ্যে আমরা সেই ঐশ্বর্য দেখি। যখন দেখি, কোনো বীরপুরুষ ধর্মের জন্য স্বার্থ ছাড়িয়াছেন, প্রাণ দিয়াছেন, তখন এমন একটা আশ্চর্য পদার্থ আমাদের চোখে পড়ে যাহা আমাদের সুখদুঃখের চেয়ে বেশি, আমাদের স্বার্থের চেয়ে বড়ো, আমাদের প্রাণের চেয়ে মহৎ। মঙ্গল নিজের এই ঐশ্বর্যের জোরে ক্ষতি ও ক্লেশকে ক্ষতি ও ক্লেশ বলিয়া গণ্যই করে না। স্বার্থের ক্ষতিতে তাহার ক্ষতি হইবার জো নাই। এইজন্য সৌন্দর্য যেমন আমাদিগকে স্বেচ্ছাকৃত ত্যাগে প্রবৃত্ত করে, মঙ্গলও সেইরূপ করে। সৌন্দর্যও জগদ্ব্যাপারের মধ্যে ঈশ্বরের ঐশ্বর্যকে প্রকাশ করে, মঙ্গলও মানুষের জীবনের মধ্যে তাহাই করিয়া থাকে। মঙ্গল, সৌন্দর্যকে শুধু চোখের দেখা নয়, শুধু বুদ্ধির বোঝা নয়, তাহাকে আরো ব্যাপক আরো গভীর করিয়া মানুষের কাছে আনিয়া দিয়াছে; তাহা ঈশ্বরের সামগ্রীকে অত্যন্তই মানুষের সামগ্রী করিয়া তুলিয়াছে। বস্তুত মঙ্গল মানুষের নিকটবর্তী অন্তরতম সৌন্দর্য; এইজন্যই তাহাকে আমরা অনেক সময় সহজে সুন্দর বলিয়া বুঝিতে পারি না, কিন্তু যখন বুঝি তখন আমাদের প্রাণ বর্ষার নদীর মতো ভরিয়া উঠে। তখন আমরা তাহার চেয়ে রমণীয় আর কিছুই দেখি না।
ফুল পাতা, প্রদীপের মালা এবং সোনরুপার থালি দিয়া যদি ভোজের জায়গা সাজাইতে পারো সে তো ভালোই, কিন্তু নিমন্ত্রিত যদি যজ্ঞকর্তার কাছ হইতে সমাদর না পায়, হৃদ্যতা না পায়, তবে সে-সমস্ত ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য তাহার কাছে রোচে না; কারণ, এই হৃদ্যতাই অন্তরের ঐশ্বর্য, অন্তরের প্রাচুর্য। হৃদ্যতার মিষ্টহাস্য মিষ্টবাক্য মিষ্টব্যবহার এমন সুন্দর যে তাহা কলার পাতাকেও সোনার থালার চেয়ে বেশি মূল্য দেয়। সকলের কাছেই যে দেয় এ কথাও বলিতে পারি না। বহু-আড়ম্বরের ভোজে অপমান স্বীকার করিয়াও প্রবেশ করিতে প্রস্তুত এমন লোকও অনেক দেখা যায়। কেন দেখা যায়? কারণ, ভোজের বড়ো তাৎপর্য বৃহৎ সৌন্দর্য সে বোঝে না। বস্তুত খাওয়াটা বা সজ্জাটাই ভোজের প্রধান অঙ্গ নহে। কুঁড়ির পাপড়িগুলি যেমন নিজের মধ্যেই কুঞ্চিত তেমনি স্বার্থরত মানুষের শক্তি নিজের দিকেই চিরদিন সংকুচিত, একদিন তাহার বাঁধন ঢিলা করিয়া তাহাকে পরাভিমুখ করিবামাত্র ফোটা ফুলের মতো বিশ্বের দিকে তাহার মিলনমাধুর্যময় অতি সুন্দর বিস্তার ঘটে; যজ্ঞের সেই ভিতর-দিকটার গভীরতর মঙ্গলসৌন্দর্য যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ দেখিতে পায় না তাহার কাছে ভোজ্যপেয়ের প্রাচুর্য ও সাজসজ্জার আড়ম্বরই বড়ো হইয়া উঠে। তাহার অসংযত প্রবৃত্তি, তাহার দানদক্ষিণাপোনভোজনের অতিমাত্র লোভ, যজ্ঞের উদার মাধুর্যকে ভালো করিয়া দেখিতে দেয় না।
শাস্ত্র বলে : শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা। ক্ষমাই শক্তিমানের ভূষণ। কিন্তু ক্ষমাপ্রকাশের মধ্যেই শক্তি সৌন্দর্যঅনুভব তো সকলের কর্ম নহে। বরঞ্চ সাধারণ মূঢ় লোকেরা শক্তির উপদ্রব দেখিলেই তাহার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ করে। লজ্জা স্ত্রীলোকের ভূষণ। কিন্তু সাজসজ্জার চেয়ে এই লজ্জার সৌন্দর্য কে দেখিতে পায়? যে ব্যক্তি সৌন্দর্যকে সংকীর্ণ করিয়া দেখে না। সংকীর্ণ প্রকাশের তরঙ্গভঙ্গ যখন বিস্তীর্ণ প্রকাশের মধ্যে শান্ত হইয়া গেছে তখন সেই বড়ো সৌন্দর্যকে দেখিতে হইলে উচ্চভূমি হইতে প্রশস্ত ভাবে দেখা চাই। তেমন করিয়া দেখার জন্য মানুষের শিক্ষা চাই, গাম্ভীর্য চাই, অন্তরের শান্তি চাই।
আমাদের দেশের প্রাচীন কবিরা গর্ভিণী নারীর সৌন্দর্যবর্ণনায় কোথাও কুণ্ঠাপ্রকাশ করেন নাই। য়ুরোপের কবি এখানে একটা