শৈলবালা। বিধাতা মাপ করতে পারেন, কিন্তু আমি করব না। ও খাতাটির 'পরে আমার লোভ আছে বিপিনবাবু।
রসিক। আর, আমি বুঝি লোভ মোহ সমস্ত জয় করে বসে আছি? আহা, হাতের অক্ষরের মতো জিনিস আর আছে? মনের ভাব মূর্তি ধ'রে আঙুলের আগা দিয়ে বেরিয়ে আসে — অক্ষরগুলির উপর চোখ বুলিয়ে গেলে হৃদয়টি যেন চোখে এসে লাগে। অবলাকান্ত, এ খাতাখানি ছেড়ো না ভাই। তোমাদের চঞ্চলা নীরবালা দেবী কৌতুকের ঝরনার মতো দিনরাত ঝরে পড়ছে, তাকে তো ধরে রাখতে পার না, এই খাতাখানির পত্রপুটে তারই একটি গণ্ডূষ ভরে উঠেছে — এ জিনিসের দাম আছে। বিপিনবাবু, আপনি তো নীরবালাকে জানেন না, আপনি এ খাতাখানা নিয়ে কী করবেন।
বিপিন। আপনারা তো স্বয়ং তাঁকেই জানেন, খাতাখানিতে আপনাদের প্রয়োজন কী। এই খাতা থেকে আমি যেটুকু পরিচয় প্রত্যাশা করি তার প্রতি আপনারা দৃষ্টি দেন কেন।
শ্রীশের প্রবেশ
শ্রীশ। মনে পড়েছে মশায়। সেদিন এখানে একটা বইয়েতে নাম দেখেছিলেম, নৃপবালা নীরবালা — এ কী, বিপিন যে! তুমি এখানে হঠাৎ?
বিপিন। তোমার সম্বন্ধেও ঠিক ঐ প্রশ্নটা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
শ্রীশ। আমি এসেছিলুম আমার সেই সন্ন্যাসীসম্প্রদায়ের কথাটা অবলাকান্তবাবুর সঙ্গে আলোচনা করতে। ওঁর যেরকম চেহারা, কণ্ঠস্বর, মুখের ভাব, উনি ঠিক আমার সন্ন্যাসীর আদর্শ হতে পারেন। উনি যদি ওঁর ঐ চন্দ্রকলার মতো কপালটিতে চন্দন দিয়ে, গলায় মালা প'রে, হাতে একটি বীণা নিয়ে, সকালবেলায় একটি পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করেন তা হলে কোন্ গৃহস্থের হৃদয় না গলাতে পারেন।
রসিক। বুঝতে পারছি নে মশায়, হৃদয় গলাবার কি খুব জরুরি দরকার হয়েছে।
শ্রীশ। চিরকুমার - সভা হৃদয় গলাবার সভা।
রসিক। বলেন কী। তবে আমার দ্বারা কী কাজ পাবেন।
শ্রীশ। আপনার মধ্যে যেরূপ উত্তাপ আছে আপনি উত্তরমেরুতে গেলে সেখানকার বরফ গলিয়ে বন্যা করে দিয়ে আসতে পারেন। — বিপিন, উঠছ নাকি।
বিপিন। যাই, আমাকে রাত্রে একটু পড়তে হবে।
রসিক। ( জনান্তিকে ) অবলাকান্ত জিজ্ঞাসা করছেন, পড়া হয়ে গেলে বইখানা কি ফেরত পাওয়া যাবে।
বিপিন। ( জনান্তিকে ) পড়া হয়ে গেলে সে আলোচনা পরে হবে, আজ থাক্।
শৈলবালা। ( মৃদুস্বরে ) শ্রীশবাবু ইতস্তত করছেন কেন, আপনার কিছু হারিয়েছে নাকি।
শ্রীশ। ( মৃদুস্বরে ) আজ থাক্, আর - একদিন খুঁজে দেখব।
[ শ্রীশ ও বিপিনের প্রস্থান
নীরবালা। ( দ্রুত প্রবেশ করিয়া ) এ কী রকমের ডাকাতি দিদি। আমার গানের খাতাখানা নিয়ে গেল! আমার ভয়ানক রাগ হচ্ছে।
রসিক। রাগ শব্দে নানা অর্থ অভিধানে কয়।
নীরবালা। আচ্ছা পণ্ডিতমশায়, তোমার অভিধান জাহির করতে হবে না — আমার খাতা ফিরিয়ে আনো।