অক্ষয়। বসন্তনিশীথে যখন প্রেয়সী গর্জন করে বলেন ‘আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাব, আমার একদণ্ড এখানে থাকতে ইচ্ছে নেই — আমার হাড় কালি হল — আমার — '
পুরবালা। হাঁগো মশায়, কবে তোমার প্রেয়সী বাপের বাড়ি যাব ব'লে বসন্তনিশীথে গর্জন করেছে।
অক্ষয়। ইতিহাসের পরীক্ষা? কেবল ঘটনা রচনা করে নিষ্কৃতি নেই? আবার সন তারিখ-সুদ্ধ মুখে মুখে বানিয়ে দিতে হবে? আমি কি এতবড়ো প্রতিভাশালী।
রসিক। ( পুরবালার প্রতি ) বুঝেছ ভাই, সোজা করে ও তোমার কথা বলতে পারে না — ওর এত ক্ষমতাই নেই — তাই উলটে বলে ; আদরে না কুলোলে গাল দিয়ে আদর করতে হয়।
পুরবালা। আচ্ছা মল্লিনাথজি, তোমার আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। মা যে শেষকালে তোমাকেই কাশী নিয়ে যাবেন স্থির করেছেন।
রসিক। তা, বেশ তো, এতে আর ভয়ের কথাটা কী। তীর্থে যাবার তো বয়সই হয়েছে। এখন তোমাদের লোলকটাক্ষে এ বৃদ্ধের কিছুই করতে পারবে না — এখন চিত্ত চন্দ্রচূড়ের চরণে —
মুগ্ধস্নিগ্ধবিদগ্ধলুব্ধমধুরৈর্লোলৈঃ কটাক্ষৈরলং
চেতঃ সম্প্রতি চন্দ্রচূড়চরণধ্যানামৃতে বর্ততে।
পুরবালা। সে তো খুব ভালো কথা, তোমার উপরে আর কটাক্ষের অপব্যয় করতে চাই নে, এখন চন্দ্রচূড়চরণে চলো — তা হলে মাকে ডাকি।
রসিক। ( করজোড়ে ) বড়দিদিভাই, তোমার মা আমাকে সংশোধনের বিস্তর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু একটু অসময়ে সংস্কারকার্য আরম্ভ করেছেন — এখন তাঁর শাসনে কোনো ফল হবে না। বরঞ্চ এখনো নষ্ট হবার বয়স আছে, সে বয়সটা বিধাতার কৃপায় বরাবরই থাকে,লোল কটাক্ষটা শেষকাল পর্যন্ত খাটে, কিন্তু উদ্ধারের বয়স আর নেই। তিনি এখন কাশী যাচ্ছেন, কিছুদিন এই বৃদ্ধ শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতিসাধনের দুরাশা পরিত্যাগ করে শান্তিতে থাকুন — কেন তোরা তাঁকে কষ্ট দিবি।
জগত্তারিণীর প্রবেশ
জগত্তারিণী। বাবা, তা হলে আসি।
অক্ষয়। চললে নাকি মা? রসিকদাদা যে এতক্ষণ দুঃখ করছিলেন যে তুমি —
রসিক। ( ব্যাকুলভাবে ) দাদার সকল কথাতেই ঠাট্টা। মা, আমার কোনো দুঃখ নেই, আমি কেন দুঃখ করতে যাব।
অক্ষয়। বলছিলে না যে ‘বড়োমা একলাই কাশী যাচ্ছেন, আমাকে সঙ্গে নিলেন না'?
রসিক। হাঁ, সে তো ঠিক কথা। মনে তো লাগতেই পারে, তবে কিনা মা যদি নিতান্তই —
জগত্তারিণী। না বাপু, বিদেশে তোমার রসিকদাদাকে সামলাবে কে। ওঁকে নিয়ে পথ চলতে পারব না।
পুরবালা। কেন মা, রসিকদাদাকে নিয়ে গেলে উনি তোমাকে দেখতে - শুনতে পারতেন।
জগত্তারিণী। রক্ষে করো, আমাকে আর দেখে - শুনে কাজ নেই। তোমার রসিকদাদার বুদ্ধির পরিচয় ঢের পেয়েছি।
রসিক। ( টাকে হাত বুলাইতে বুলাইতে ) তা, মা, যেটুকু বুদ্ধি আছে তার পরিচয় সর্বদাই দিচ্ছি, ও তো চেপে রাখবার জো নেই — ধরা পড়তেই হবে। ভাঙা চাকাটাই সব চেয়ে খড়্ খড়্ করে, তিনি যে ভাঙা সেটা পাড়াসুদ্ধ খবর পায়। সেইজন্যেই বড়োমা, চুপচাপ করে থাকতেই চাই, কিন্তু তুমি যে আবার চালাতেও ছাড় না।
জগত্তারিণী। আমি তা হলে হারানের বাড়ি চললুম, একেবারে তাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠব; এর পরে আর যাত্রার সময় নেই।