নীরজা। তোমরা পুরুষেরা যখন একবার নিজের হৃদয়ের কথা ভাব, তখন পরের হৃদয়ের দিকে একবার চেয়ে দেখতে পার না। নিজের সুখ দুঃখের সঙ্গে যতটুকু যোগ সেইটুকুই দেখতে পাও,তার সুখ দুঃখ চোখে পড়েও না। সে যে কি দুঃখে চ’লে যায়,তা তোমরা দেখ না–তোমরা কেবল ভাবো আমার সঙ্গে কথা কইলে না,আমার কাছ থেকে চ’লে গেল।
নীরদ। তা হবে! আমরা স্বার্থপর, সেই জন্যেই আমরা অন্ধ। কিন্তু ও কথা আর কেন? ও-সব কথা আমি মন থেকে একেবারে তাড়িয়ে দিয়েছি। আর তো আমি তাকে ভালোবাসি নে; ভালোবাসতে পারিও না! তবে ও কথা থাক্। আর একটা কথা বলা যাক। দেখ নীরজা, যদিও আমাদের বিবাহের দিন কাছে এসেছে,তবু মনে হচ্ছে যেন এখনো কত দিন বাকী আছে! সময় যেন আর কাটছে না!
নীরজা। ( নীরদের হাত ধরিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া ) নীরদ,আমার চোখে জল আসচে,কিছু মনে করো না। বিবাহের দিন ত কাছে আসচে,এই সময় একবার মনে ক’রে দেখ আমরা কি করছি – কোথায় যাচ্ছি। দেখো ভাই, আমাদের এ বাসরঘর শ্মশানের উপর গড়া নয়ত! তার চেয়ে এসো,
নীরদ। কিন্তু নীরজা,এদেশে কেবল শোভাই আছে, এদেশে হৃদয় নেই।
নীরজা। তা হতেই পারে না। এত সৌন্দর্য্যের মধ্যে হৃদয় নেই এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না!
নীরদ। সৌন্দর্য্যকে দেখবামাত্রই লোকে তাকে বিশ্বাস ক’রে ফেলে এই জন্যেই তো পৃথিবীতে এত দুঃখ-যন্ত্রণা! সে কথা যাক – নলিনীদের বাড়ীতে আজ বসন্ত-উৎসব – আমাদের নিমন্ত্রণ হয়েচে, একটু শীগ্গির শীগ্গির যেতে হবে।
নীরজা। আমার একটি কথা রাখবে? আমি বলি ভাই, সেখানে আমাদের না যাওয়াই ভালো।
নীরদ। কেন? নীরজা। কেন, তা জানি নে, কিন্তু কে জানে,আমার মনে হচ্চে সেখানে আজ না গেলেই ভালো! নীরদ। নীরজা,তুমি কি আমার ভালোবাসার প্রতি সন্দেহ কর? নীরজা। প্রিয়তম, এ প্রশ্ন যদি তোমার মনে এসে থাকে – তবে থাক্ – তবে আর আমি অধিক কিছু বলোব না – তুমি চল! নীরদ। আমি তো যাওয়াই ভালো বিবেচনা করি! আজ আমার কি গর্বের দিন! তোমাকে সঙ্গে ক’রে যখন নিয়ে যাব, নলিনী দেখবে আমাকে ভালোবাসবারও এক জন লোক আছে।
নীরদ। আমরা বড়ো সকাল সকাল এসেছি। এখনো একজনও লোক আসে নি। (স্বগত) সেই ত সব তেমনিই রয়েছে ! সেই-সব মনে পড়ছে ! এই বকুলের তলায় ফুলগুলির উপর সে খেলা ক’রে বেড়াত ! সূর্য্যের আলো তার সঙ্গে সঙ্গে যেন নৃত্য করত! তার হাসিতে গানেতে,তার সেই সরল প্রাণের আনন্দ-হিল্লোলে গাছের কুঁড়িগুলি যেন ফুটে উঠত। আমি কি ঘোর স্বার্থপর! সে হাসি, সে গান আমার কেন ভালো লাগত না। সেই জীবন্ত সৌন্দর্য্যরাশি আমি কেন উপভোগ করতে পারতুম না। এক দিন মনে আছে সকাল বেলায় ঐ কামিনী গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সুকুমার হাতটি বাড়িয়ে সে অন্যমনস্কে কামিনী ফুল তুলছিল,আমি পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ চমকে উঠে তার আঁচল থেকে ফুলগুলি প’ড়ে গেল,তার সেই চকিত নেত্র তার সেই লজ্জাবনত মুখখানি