বৃহস্পতি। হে সৌম্য, তেত্রিশ কোটি দেবতাতেও কি ইন্দ্রলোক পূর্ণ হয় নাই? আরো কি নূতন দেবতা আমন্ত্রণের আবশ্যক আছে? হে প্রিয়দর্শন, স্মরণ রাখিয়ো, জন্মমৃত্যুর দ্বারা মর্তলোকে লোকসংখ্যা নিয়মশাসনে থাকে, কিন্তু স্বর্গলোকে মৃত্যুর অভাবে দেবসংখ্যা হ্রাস করিবার কোনো উপায় নাই; অতএব সংখ্যা বৃদ্ধি করিবার পূর্বে সবিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখা কর্তব্য।
ইন্দ্র। হে সুরগুরো, স্বর্গের পথ দুর্গম করিবার জন্য স্বর্গাধিপতির চেষ্টার ত্রুটি নাই এ কথা সর্বজনবিদিত।
বৃহস্পতি। পাকশাসন নাকপতে, তবে কেন অধুনা দেবলোকে মনসা শীতলা ঘেঁটু-নামধারী অঞ্জাতকুলশীল নব নব দেবতার অভিষেক হইতেছে?
ইন্দ্র। দ্বিজোত্তম, আমরা দেবতাগণ ত্রিভুবনের কর্তৃত্বভার প্রাপ্ত হইয়াছি বটে, কিন্তু সে কেবল ত্রিভুবনের সম্মতিক্রমে। এ কথা গুরুদেবের অগোচর নাই যে, মর্তলোকেই দেবতাদের নির্বাচন হইয়া থাকে। এক কালে আর্যাবর্তের সমস্ত ব্রাহ্মণ হোতাগণ আমাকেই স্বর্গের প্রধানপদ দিয়াছিলেন এবং তৎকালে সরস্বতী-দৃশদ্বতীতীরের প্রত্যেক যজ্ঞহুতাশনে আমার উদ্দেশে অহরহ যে হবি সমর্পিত হইত তাহার হোমধূমে আমার সহস্রলোচন হইতে নিরন্তর অশ্রু প্রবাহিত হইত। অদ্য নরলোকে হবিঘৃত কেবলমাত্র জঠরযজ্ঞে ক্ষুধাসুরের উদ্দেশেই উপহৃত হইয়া থাকে এবং শুনিতে পাই সে ঘৃতও বিশুদ্ধ নহে।
বৃহস্পতি। বৃত্রনিসূদন, সেই অপবিত্র বিমিশ্র ঘৃত-পানে, শুনিতে পাই, ক্ষুধাসুর মৃতপ্রায় হইয়া আসিয়াছে। হে শত্রু, দেবতাদের প্রতি দেবদেবের বিশেষ কৃপা আছে, সেইজন্যই নরলোকে হোমাগ্নি নির্বাপিত হইয়াছে, নতুবা নব্য গব্য পরিপাক করিতে হইলে, ভো পাকশাসন, দেবজঠরের সমস্ত অমৃতরস সুতীব্র অম্লরসে পরিণত হইত, অগ্নিদেবের মন্দাগ্নি এবং বায়ুদেবের বায়ুপরিবর্তন আবশ্যক হইত, এবং সমস্ত দেবতার অমরবক্ষে অসহ্য শূলবেদনা অমর হইয়া বাস করিত।
ইন্দ্র। হে জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ, উক্ত ঘৃতের গুণাগুণ আমার অবিদিত নাই, যেহেতু যমরাজের নিকট সর্বদাই তাহার বিবরণ শুনিতে পাই। অতএব হব্যপদার্থে আমার কিছুমাত্র লোভ নাই, এবং হোমাগ্নির তিরোধান সম্বন্ধেও আমি আক্ষেপ করিতেছি না। আমার বক্তব্য এই যে, যেমন পুষ্প হইতে সৌরভ উত্থিত হয় তেমনি মর্তের ভক্তি হইতেই স্বর্গ উর্ধ্বলোকে উদ্বাহিত হইতে থাকে; সেই ভক্তিপুষ্প যদি শুষ্ক হইয়া যায় তবে, হে দ্বিজসত্তম, তেত্রিশ কোটি দেবতাও আমার এই পারিজাতমোদিত নন্দনবনবেষ্টিত স্বর্গলোক রক্ষা করিতে পারিবে না। সেই কারণে, মর্তের সহিত যোগপ্রবাহ রক্ষা করিবার জন্য মাঝে মাঝে নরলোকের নবনির্বাচিত দেবতাগুলিকে সাদরে স্বর্গে আবাহন করিয়া আনিতে হয়। হে ত্রিকালজ্ঞ, স্বর্গের ইতিহাসে এমন ঘটনা ইতিপূর্বেও ঘটিয়াছে।
বৃহস্পতি। মেঘবাহন, সে-সমস্ত ইতিহাস আমার অগোচর নাই। কিন্তু ইতিপূর্বে যে-সকল নূতন দেবতা মর্ত হইতে স্বর্গলোকে উন্নীত হইয়াছিলেন তাঁহারা অভিজাত দেবগণের সহিত একাসনে বসিবার উপযুক্ত। সম্প্রতি ঘেঁটুপ্রমুখ যে-সমস্ত দেবতাগণ তোমার নিমন্ত্রণে স্বর্গে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছেন তাঁহারা সুরসভার দিব্যজ্যোতি ম্লান করিয়া দিয়াছেন। অদিতিনন্দন, আমার প্রস্তাব এই যে, তাঁহাদের জন্য একটি উপদেবলোক সৃজন করিবার জন্য বিশ্বকর্মার প্রতি বিশেষ ভারার্পণ করা হয়।
ইন্দ্র। বুধপ্রবর, তাহা হইলে সেই উপস্বর্গই স্বর্গ হইয়া দাঁড়াইবে এবং স্বর্গ উপসর্গ হইবে মাত্র। একমাত্র বেদমন্ত্রের উপর আমাদের স্বর্গ প্রতিষ্ঠিত। জর্মন্দেশীয় পণ্ডিতগণের বহুল চেষ্টা সত্ত্বেও সে মন্ত্র এবং তাহার অর্থ সকলে বিস্মৃত হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু আমাদের নূতন আমন্ত্রিত দেবদেবীগণ, সায়নাচার্যের ভাষ্য, পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের পুরাতত্ত্ব অথবা তাঁহাদের প্রাচ্যশিষ্যবর্গের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিতেছেন না, তাঁহারা প্রতিদিনের সদ্য-আহরিত পূজা প্রাপ্ত হইয়া উপবাসী পুরাতন দেবতাদের