ছি বাবা উমেশ, তোমার এত বয়স হল, তবু কার সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করতে হয় শিখলে না? যে ভগীরথ মর্তে গঙ্গা এনেছিলেন তাঁর গল্প মহাভারতে পড়েছ তো? ভুল করছ— ঐরাবত নয়, সে ভগীরথ। আমাকে সেই ভগীরথ বলে জেনো। বুঝেছ? মনে থাকবে তো? ভগীরথ, ঐরাবত নয়। সেই জায়গাটা মাস্টারের কাছে পড়ে নিয়ো। এসো বাবা, তোমার মাথায় পায়ের ধুলো দিয়ে দিই।
কই? ভাত কই? আমি আর সবুর করতে পারছি নে— দেশ-দেশান্তর থেকে সব লোক আসছে। কী গো গিন্নি, এত রাগ কিসের? হয়েছে কী? খিড়কির পুকুরে লোকজনের ভিড় হয়েছে? নাওয়া, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, জল তোলা, সমস্ত বন্ধ হয়েছে? কী করব বলো। আমি স্বয়ং ভগীরথ হয়ে গঙ্গা থেকে তো কাউকে বঞ্চিত করতে পারি নে। তা হলে আমি এত তপিস্যে করে এত কষ্ট করে গঙ্গা আনলুম কেন? তোমাদের ময়লা কাপড় কাচবার জন্যে— বটে! যখন ব্রাহ্মণের সঙ্গে মকদ্দমা করছিলুম তখন তোমরা সেই আশায় বসেছিলে, আসল কথাটা কেবল আমি জানতুম আর মা গঙ্গাই জানতেন।— কী! এতবড়ো আস্পর্ধা— তুই বিশ্বাস করিস নে! জানিস, তোকে বিয়ে করে তোর চোদ্দপুরুষকে উদ্ধার করেছি। বাপের বাড়ি যাবে? যাও-না! মরবার সময় আমার এই গঙ্গায় আসতে দেব না। সেটা মনে রেখো। ভাত আর আছে তো? নেই? আমি যে তোমাকে বেশি করে রাঁধতে বলে দিয়েছিলুম। আমার প্রসাদ নিয়ে যাবে বলে যে দেশ-বিদেশ থেকে লোক এসেছে। যা রেঁধেছ, এর একটা একটা ভাত খুঁটে দিলেও যে কুলোবে না। রান্নাঘরে যত ভাত আছে সব নিয়ে এসো— তোমরা সব চিঁড়ে আনতে দাও, পুকুর থেকে গঙ্গাজল এনে ভিজিয়ে খেয়ো। কী করব বলো। দূর থেকে নাম শুনে প্রসাদ নিতে এসেছে, তাদের ফেরাতে পারব না। কী বললে? আমার হাতে পড়ে তোমার হাড় জ্বালাতন হয়ে গেল? কী বলব, তুমি মুর্খু মেয়েমানুষ, ঐ কথাটা একবার দেশের ভালো ভালো পণ্ডিতদের কাছে বলো দেখি। তারা তখনি মুখের উপর শুনিয়ে দেবে, ষাট হাজার সগরসন্তান জ্ব'লে ভস্ম হয়ে গিয়েছিল, সেই ভস্মে যিনি প্রাণ দিয়েছেন, তিনি যে তোমার হাড় জ্বালাবেন এ কথা কোনো শাস্ত্রের সঙ্গেই মিলছে না। তুমি গাল দাও, আমি আমার ভক্তদের কাছে চললুম।
(বাহিরে আসিয়া) দেরি হয়ে গেল। বাড়ির মধ্যে এঁয়ারা সব আবার কিছুতেই ছাড়েন না, পায়ের ধুলো নিয়ে পুজো করে বেলা করে দিলেন। আমি বলি, থাক্ থাক্, আর কাজ নেই— তারা কি ছাড়ে! এসো, তোমরা একে একে এসো, যার যার ধুলো নেবার আছে নিয়ে বাড়ি যাও— কী হে বিপিন? আজ মকদ্দমার দিন? তা তো যেতে পারছি নে। দর্শন করতে সব লোকজন আসছে। এক-তরফা ডিক্রি হবে? কী করব বলো। আমি উপস্থিত না থাকলে এখানেও যে এক-তরফা হয়। বিপ্নে, তুই যাবার সময় প্রণাম করে গেলি নে? এমনি করেই অধঃপাতে যাবে। আয়, এইখানে গড় কর, এই নে, ধুলো নে। যা।
ওহে মুখুজ্জে, মা গঙ্গা ঠিক আমার এই খিড়কির কাছটায় না এসে আর রশি দুয়েক তফাতে এলেই ভালো করতেন। তুমি তো দাদা, স্বপ্ন দেখেই সারলে, আমাকে যে দিনরাত্তির অসহ্য ভোগ ভুগতে হচ্ছে। এক তো, পুকুরের জল দুধে বাতাসায় ডাবে আর পদ্মের পাতায় পচে দুর্গন্ধ হয়ে উঠেছে, মাছগুলো মরে মরে ভেসে উঠছে, যেদিন দক্ষিণের বাতাস দেয় সেদিন মনে হয় যেন নরককুণ্ডুর দক্ষিণের জানলা-দরজাগুলো সব কে খুলে দিয়েছে— সাত জন্মের পেটের ভাত উঠে আসবার জো হয়। ছেলেগুলো যে ক'টা দিন ছিল কেবল ব্যামোয় ভুগেছে। কলিযুগের ভগীরথ হয়ে ডাক্তারের ফি দিতে দিতেই সর্বস্বান্ত হতে হল; তারা সব যমদূত, ভক্তির ধার ধারে না, স্বয়ং মা গঙ্গাকে দেখতে এলে পুরো ভিজিট আদায় করে ছাড়ে। সেও সহ্য হয়, কিন্তু খিড়কির ধারে ঐ-যে দেশ-বিদেশের মড়া পুড়তে আরম্ভ হয়েছে ঐটেতে আমাকে কিছু কাবু করেছে। অহর্নিশি চিতা জ্বলছে। কাছাকাছি যে-সমস্ত বসতি