Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (http://rabindra-rachanabali.nltr.org)


চার অধ্যায় - দ্বিতীয় অধ্যায়, ১৪
চার অধ্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায়
এলা বসে আছে কেদারায়, পিঠে বালিশ গোঁজা। লিখছে একমনে। পায়ের উপর পা তোলা। দেশবন্ধুর মূর্তি-আঁকা খাতা কাঠের বোর্ডে কোলের উপর আড় করে ধরা। দিন ফুরোতে দেরি নেই, কিন্তু তখনো চুল রয়েছে অযত্নে। বেগনি রঙের খদ্দরের শাড়ি গায়ে, সেটাতে মলিনতা অব্যক্ত থাকে, তাই নিভৃতে ব্যবহারে তার অনাদৃত প্রয়োজন। এলার হাতে একজোড়া লালরঙ-করা শাঁখা, গলায় একছড়া সোনার হার। হাতির দাঁতের মতো গৌরবর্ণ শরীরটি আঁটসাঁট; মনে হয় বয়স খুব কম কিন্তু মুখে পরিণত বুদ্ধির গাম্ভীর্য। খদ্দরের সবুজ রঙের চাদরে ঢাকা সংকীর্ণ লোহার খাট ঘরের প্রান্তে দেয়াল-ঘেঁষা। নারায়ণী স্কুলের তাঁতে-বোনা শতরঞ্চ মেঝের উপর পাতা। একধারে লেখবার ছোটো টেবিলে ব্লটিং প্যাড; তার একপাশে কলম পেনসিল সাজানো দোয়াত-দান, অন্যধারে পিতলের ঘটিতে গন্ধরাজ ফুল। দেয়ালে ঝুলছে কোনো একটি দূরবর্তী কালের ফোটোগ্রাফের প্রেতাত্মা, ক্ষীণ হলদে রেখায় বিলীনপ্রায়। অন্ধকার হল, আলো জ্বালবার সময় এসেছে। উঠি-উঠি করছে এমন সময় খদ্দরের পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে অতীন্দ্র দমকা হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকেই ডাক দিল, “এলী।”

এলা খুশিতে চমকে উঠে বললে, “অসভ্য, জানান না দিয়ে এ ঘরে আসতে সাহস কর।”

এলার পায়ের কাছে ধপ করে মেঝের উপর বসে অতীন বললে, “জীবনটা অতি ছোটো, কায়দাকানুন অতি দীর্ঘ, নিয়ম বাঁচিয়ে চলবার উপযুক্ত পরমায়ু ছিল সনাতন যুগে মান্ধাতার। কলিকালে তার টানাটানি পড়েছে।”

“আমার কাপড় ছাড়া হয় নি এখনও।”

“ভালোই। তা হলে আমার সঙ্গে মিশ খাবে। তুমি থাকবে রথে, আমি থাকব পদাতিক হয়ে– এ-রকম দ্বন্দ্ব মনুর নিয়মে অধর্ম। এককালে আমি ছিলুম নিখুঁত ভদ্রলোক, খোলসটা তুমিই দিয়েছ ঘুচিয়ে। বর্তমান বেশভূষাটা দেখছ কী রকম?”

“অভিধানে ওকে বেশভূষা বলে না।”

“কী বলে তবে?”

“শব্দ পাচ্ছি নে খুঁজে। বোধ হয় ভাষায় নেই। জামার সামনেটাতেই ঐ-যে বাঁকাচোরা ছেঁড়ার দাগ, ও কি তোমার স্বকৃত সেলাইয়ের লম্বা বিজ্ঞাপন?”

“ভাগ্যের আঘাত দারুণ হলেও বুক পেতেই নিয়ে থাকি– ওটা তারই পরিচয়। এ জামা দরজিকে দিতে সাহস হয় না, তার তো আত্মসম্মানবোধ আছে।”

“আমাকে দিলে না কেন?”

“নব যুগের সংস্কারভার নিয়েছ, তার উপরে পুরোনো জামার সংস্কার?”

“ওটাকে সহ্য করবার এমনই কী দরকার ছিল?”

“যে দরকারে ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে সহ্য করে।”

“তার অর্থ?”

“তার অর্থ, একটির বেশি নেই বলে।”

“কী বল তুমি অন্তু! বিশ্বসংসারে তোমার ওই একটি বৈ জামা আর নেই?”
“বাড়িয়ে বলা অন্যায়, তাই কমিয়ে বললুম। পূর্ব আশ্রমে শ্রীযুক্ত অতীন্দ্রবাবুর জামা ছিল বহুসংখ্যক ও বহুবিধ। এমন সময়ে দেশে এল বন্যা। তুমি বক্তৃতায় বললে, যে অশ্রুপ্লাবিত দুর্দিনে, (মনে আছে অশ্রুপ্লাবিত বিশেষণটা?) বহু নরনারীর লজ্জা রক্ষার মতো কাপড়