যা মনে করেছিলুম তাই বটে। আহা, মুখটি দেখতে পেলে বেশ হত। —আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
কমলমুখী। হাঁ। আপনি বোধ হয় আমার অবস্থা সবই জানেন।
বিনোদবিহারী। কিছু কিছু শুনেছি। —গলাটা যে তারই মতন শোনাচ্ছে। সব মেয়েরই গলা প্রায় একরকম দেখছি। কিন্তু তার চেয়ে কত মিষ্টি!
কমলমুখী। আমার পুরুষ অভিভাবক কেউ নেই—বিবাহ করি নি পাছে স্বামী আমার চেয়ে আমার বিষয়সম্পত্তির বেশি আদর করেন—পাছে শাঁসটুকু নিয়ে আমাকে খোলার মতো ফেলে দেন।
বিনোদবিহারী। আপনি আমাকে বৈষয়িক পরামর্শের জন্যে ডেকেছেন, অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলা আমার উচিত হয় না; কিন্তু মানুষের মানসিক বিষয়েও আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। আপনি বোধ হয় শুনে থাকবেন আমি অবসরমত কিঞ্চিৎ সাহিত্যচর্চাও করে থাকি। আমাকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু বিবাহ সম্বন্ধে আপনি যেরকম ভাবছেন ওটা আপনার ভুল। যেমন বোঁটার সঙ্গে ফুল তেমনি ধনের সঙ্গে স্ত্রী। অর্থাৎ ধন থাকলে স্ত্রীকে গ্রহণ করবার সুবিধা হয়—নইলে তাকে বেশ সুচারুরূপে ধরে রাখবার সুযোগ হয় না। অনেক সময় বোঁটা নেই বলে ফুল হাত থেকে পড়ে যায়, কিন্তু এতবড়ো অরসিক মূর্খ কে আছে যে ফুল ফেলে দিয়ে বোঁটাটি রেখে দেয়!
কমলমুখী। আমি পুরুষজাতকে ভালো চিনি নে, কাজেই সাহস পাই নে। যাই হোক, সংসারকার্যে পুরুষেরা যতই অনাবশ্যক হোক বিষয়কর্ম তাদের না হলে চলে না। তাই আমি আমার সমস্ত বিষয়সম্পত্তির অধ্যক্ষতার ভার আপনার উপর দিতে ইচ্ছে করি—
বিনোদবিহারী। আমার প্রাণপণ সাধ্যে আমি আপনার কাজ করে দেব। সে যে কেবল বেতনের প্রত্যাশায়, অনুগ্রহ করে তা মনে করবেন না। আমাকে কেবলমাত্র আপনার ভৃত্য বলে জানবেন না, আমি—
কমলমুখী। না না, আপনি ভৃত্যের ভাবে থাকবেন কেন—আপনাকে আমার বন্ধুস্বরূপ জ্ঞান করব—আপনি মনে করবেন যেন আপনারই কাজ আপনি করছেন—
বিনোদবিহারী। তার চেয়ে ঢের বেশি মনে করব—কারণ, এ পর্যন্ত কখনো আপনার কাজে আপনি যথেষ্ট মন দিই নি। নিজের স্বার্থরক্ষার চেয়ে উচ্চতর মহত্তর কর্তব্য যেমনভাবে সম্পন্ন করতে হয় আমি তেমনি ভাবে কাজ করব—দেবতার কাজ যেমন প্রাণপণে—
কমলমুখী। না না, আপনি অতটা বেশি কিছু ভাববেন না। আমার সম্পত্তি আপনি দেবোত্তর সম্পত্তি মনে করবেন না। কেবল এইটুকু মনে করলেই যথেষ্ট হবে যে, একজন অনাথা অবলা একান্ত বিশ্বাসপূর্বক আপনার হাতে তার যথাসর্বস্ব সমর্পণ করছে—
বিনোদবিহারী। আপনি আমার উপর এই বিশ্বাস স্থাপন করে আমাকে যে কতখানি অনুগ্রহ করলেন তা আমি বলতে পারি নে। আপনাকে তবে সত্যি কথা বলি, আমি নিতান্ত একটা লক্ষ্মীছাড়া অকর্মণ্য লোক, বোধ হয় শূন্য অহংকারে ফুলে উঠে স্রোতের ফেনার মতো মৃত্যুকাল পর্যন্ত কেবল ভেসে ভেসে বেড়াতুম। আপনার এই বিশ্বাসে আমাকে মানুষ করে তুলবে, আমার জীবনের একটা উদ্দেশ্য হবে—আমি—
কমলমুখী। আপনি এত কথা কেন বলছেন আমি বুঝতে পারছি নে—আমার এ অতি সামান্য কাজ—এর সঙ্গে আপনার জীবনের উদ্দেশ্যের যোগ কী?
বিনোদবিহারী। কাজ যেমনই হোক-না, আপনাদের বিশ্বাস আমাদের যে কত বল দেয় তা আপনারা জানেন না। এই একজন অজ্ঞাত অপরিচিত পুরুষের প্রতি আপনি যে এমন অসন্দিগ্ধভাবে নির্ভর স্থাপন করলেন এজন্যে আপনাকে কখনোই এক মুহূর্তের