লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়ে জুড়ন না গেল।
প্রেয়সীও আসে, দু-চার কথা বলেও থাকে, কিন্তু আমার ঐ বর্ণনার সঙ্গে ঠিকটি মেলে না।
নিমাই। দেখো বিনোদ, তোমাদের সঙ্গে একটা বিষয়ে আমাদের ভারি মতের অনৈক্য হয়। মেয়েমানুষ যদি বড্ড বেশি জ্যান্ত গোছের হয় তাকে নিয়ে পুরুষের কখনোই পোষায় না। দু-জন জ্যান্ত লোকে কখনো রীতিমত মিল হতে পারে? তোমার কাপড়টি যেমন বেশ নির্বিবাদে গায়ে লেগে রয়েছে স্ত্রীটি ঠিক তেমনি হওয়া চাই— এ বিষয়ে আমি ভাই সম্পূর্ণ রক্ষণশীল কিংবা স্থিতিশীল, কিংবা যা বল।
চন্দ্রকান্ত। তা বটে। মনে করো তোমার জামাটাও যদি জ্যান্ত হত, প্রতি কথায় দু-জনে আপোস করতে করতেই দিন যেত, ফস করে যে মাথাটা গলিয়ে দিয়ে প’রে ফেলবে তার জো থাকত না। তুমি যখন বোতাম আঁটতে চাও সে হয়তো তার গর্তগুলো প্রাণপণে এঁটে বসে রইল। তোমার নেমন্তন্ন আছে, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে, তোমার শাল অভিমান করে বসে আছেন; যতই টানাটানি কর কিছুতেই তাঁর আর ভাঁজ খোলে না।
নিমাই। সেই কথাই বলছি। দেখিস, আমি যাকে বিয়ে করব সে মাটি থেকে মুখ তুলবে না, তার হাসি ঘোমটার মধ্যেই মিলিয়ে যাবে, তার পায়ের মলের শব্দ শুনতে কানে দূরবীন কষতে হবে। যা হোক বিনোদ, তুমি একটা বিয়ে করে ফেলো। সর্বদা তুমি যে মনটা বিগড়ে বসে রয়েছ সে কেবল গৃহলক্ষ্মীর অভাবে। পূর্বকালে সে ছিল ভালো, বাপমায়ে ছেলেবেলায় বিয়ে দিয়ে দিত—একেবারে শিশুকালেই প্রেমরোগের টিকে দিয়ে রাখা হত।
চন্দ্রকান্ত। আমিও বিনুকে এক-একবার সে কথা বলেছি। একটি স্ত্রী সহস্র দুশ্চিন্তার জায়গা জুড়ে বসে থাকেন—বেদনার উপরে যেমন বেলেস্তারা অন্যান্য ভবযন্ত্রণার উপরে স্ত্রীর প্রয়োগটাও তেমনি।
বিনোদবিহারী। ঐ শোনো, সেই গান হচ্ছে।
নিমাই। কার গান হে।
চন্দ্রকান্ত। চূপ করে খানিকটা শোনোই-না; পরে পরিচয় দেব।
বিনোদবিহারী। চন্দ্র, আজ কী করব ভাবছিলুম, একটা মতলব মাথায় এসেছে।
চন্দ্রকান্ত। কী বলো দেখি।
বিনোদবিহারী। চলো—যে মেয়েটি গান গায় ওর সঙ্গে আজই আমার বিয়ের সম্বন্ধ করে আসি গে।
চন্দ্রকান্ত। বল কী!
বিনোদবিহারী। একটা তো কিছু করা চাই। আর তো বসে বসে ভালো লাগছে না। বিয়ে করে আসা যাক গে। অমনতরো গান শুনলে মানুষ খামকা সকলরকম দুঃসাহসিক কাজই করে ফেলতে পারে।
চন্দ্রকান্ত। কিন্তু দেখাশুনো তো করবে, আলাপ-পরিচয় তো করতে হবে? আমাদের মতো তো আর বাপমায়ে দু হাতে, চোখ-কান বুজে, ধরে বিয়ে গিলিয়ে দেবে না।