ক্ষিতিশ। কে বলে তুমি প্রকাশ করতে পার না বাঁশি, তুমি নও আর্টিস্ট্! তুমি যেন হীরেমুক্তোর হরির লুঠ দিচ্ছ। কথায় কথায় তোমার শক্তির প্রমাণ ছড়াছড়ি যায়, দেখে ঈর্ষা হয় মনে।
বাঁশরি। আমি যে মেয়ে, আমার প্রকাশ ব্যক্তিগত। বলবার লোককে প্রত্যক্ষ পেলে তবেই বলতে পারি। কেউ নেই তবু বলা–সেই বলা তো চিরকালের। আমাদের বলা নগদ বিদায়, হাতে হাতে, দিনে দিনে। ঘরে ঘরে মুহূর্তে মুহূর্তে সেগুলো ওঠে আর মেলায়।
ক্ষিতিশ। পুরুষ আর্টিস্ট্কে এবার মেরেছ ঠেলা, আচ্ছা বেশ, কাজ আরম্ভ হোক। সেদিন বলেছিলে একটা চিঠির কথা।
বাঁশরি। এই সেই চিঠি। সন্ন্যাসী বলছেন–প্রেমে মানুষের মুক্তি সর্বত্র। কবিরা যাকে বলে ভালোবাসা সেইটাই বন্ধন। তাতে একজন মানুষকেই আসক্তির দ্বারা ঘিরে নিবিড় স্বাতন্ত্র্যে অতিকৃত করে। প্রকৃতি রঙিন মদ ঢেলে দেয় দেহের পাত্রে, তাতে যে-মাতলামি তীব্র হয়ে ওঠে তাকে অপ্রমত্ত সত্যবোধের চেয়ে বেশি সত্য বলে ভুল হয়। খাঁচাকেও পাখি ভালোবাসে যদি তাকে আফিমের নেশার বশ করা যায়। সংসারে যত দুঃখ, যত বিরোধ, যত বিকৃতি সেই মায়া নিয়ে যাতে শিকলকে করে লোভনীয়। কোন্টা সত্য কোন্টা মিথ্যে চিনতে যদি চাও তবে বিচার করে দেখো কোন্টাতে ছাড়া দেয় আর কোন্টা রাখে বেঁধে। প্রেমে মুক্তি, ভালোবাসায় বন্ধন।
ক্ষিতিশ। শুনলেম চিঠি, তার পরে?
বাঁশরি। তার পরে তোমার মাথা! অর্থাৎ তোমার কল্পনা। মনে মনে শুনতে পাচ্ছ না? শিষ্যকে বলছেন, ভালোবাসা আমাকে নয়, অন্য কাউকেও নয়। নির্বিশেষ প্রেম, নির্বিকার আনন্দ, নিরাসক্ত আত্মনিবেদন, এই হল দীক্ষামন্ত্র।
ক্ষিতিশ। তা হলে এর মধ্যে সোমশংকর আসে কোথা থেকে।
বাঁশরি। প্রেমের সরকারী রাস্তায়, যে প্রেমে সকলেরই সমান অধিকার খোলা হাওয়ার মতো। তুমি লেখকপ্রবর, তোমার সামনে সমস্যাটা এই যে, খোলা হাওয়ায় সোমশংকরের পেট ভরবে কি।
ক্ষিতিশ। কী জানি। সূচনায় তো দেখতে পাচ্ছি শূন্যপুরাণের পালা।
বাঁশরি। কিন্তু, শূন্যে এসে কি ঠেকতে পারে কিছু। শেষ মোকামে তো পৌঁছল গাড়ি, এ-পর্যন্ত রথ চালিয়ে এলেন সন্ন্যাসীসারথি! আট্টা-বদলের সময় যখন একদিন আসবে তখন লাগাম পড়বে কার হাতে। সেই কথাটা বলো না রিয়লিস্ট্?
ক্ষিতিশ। যাকে ওঁরা নাক সিটকে প্রকৃতি বলেন, সেই মায়াবিনীর হাতে। পাখা নেই অথচ আকাশে উড়তে চায় যে স্থূল জীবটা তাকে যিনি ধপ্ করে মাটিতে ফেলে চট্কা দেন ভাঙিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে লাগিয়ে দেন ধুলো।
বাঁশরি। প্রকৃতির সেই বিদ্রূপটাকেই বর্ণনা করতে হবে তোমাকে। ভবিতব্যের চেহারাটা জোর কলমে দেখিয়ে দাও। বড়ো নিষ্ঠুর। সীতা ভাবলেন, দেবচরিত্র রামচন্দ্র উদ্ধার করবেন রাবণের হাত থেকে; শেষকালে মানবপ্রকৃতি রামচন্দ্র চাইলেন তাঁকে আগুনে পোড়াতে। একেই বলে রিয়ালিজ্ম্, নোঙরামিকে নয়। লেখো লেখো, দেরি কোরো না, লেখো এমন ভাষায় যা হৃৎপিণ্ডের শিরাছেঁড়া ভাষা। পাঠকেরা চমকে উঠে দেখুক, এতদিন পরে বাংলার দুর্বল সাহিত্যে এমন একটা লেখা ফেটে বেরোল যা ঝোড়ো মেঘের বুকভাঙা সূর্যাস্তের রাগী আলোর মতো।
ক্ষিতিশ। ইস্, তোমার মনটা নেমেছে ভল্ক্যানোর জঠরাগ্নির মধ্যে। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, ওদের অবস্থায় পড়লে কী