অবশেষে অমিত ফিরে এল। শহরে রাষ্ট্র কেতকীর সঙ্গে তার বিয়ে। অথচ অমিতের নিজ মুখে একদিনও যতি এ প্রসঙ্গ শোনে নি। অমিতের ব্যবহারেরও অনেকখানি বদল ঘটেছে। পূর্বের মতোই যতিকে অমিত ইংরেজি বই কিনে উপহার দেয়, কিন্তু তাকে নিয়ে সন্ধেবেলায় সে-সব বইয়ের আলোচনা করে না। যতি বুঝতে পারে, আলোচনার ধারাটা এখন বইছে এক নতুন খাদে। আজকাল মোটরে বেড়াতে সে যতিকে ডাক পাড়ে না। যতির বয়সে এ কথা বোঝা কঠিন নয় যে, অমিতের “নিরুদ্দেশ যাত্রা”র পার্টিতে তৃতীয় ব্যক্তির জায়গা হওয়া অসম্ভব।
যতি আর থাকতে পারলে না। অমিতকে নিজেই গায়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করলে, “অমিতদা, শুনলুম মিস কেতকী মিত্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে?”
অমিত একটুখানি চুপ করে থেকে বললে, “লাবণ্য কি এ খবর জেনেছে।”
“না, আমি তাকে লিখি নি। তোমার মুখে পাকা খবর পাই নি বলে চুপ করে আছি।”
“খবরটা সত্যি, কিন্তু লাবণ্য হয়তো-বা ভুল বুঝবে।”
যতী হেসে বললে, “এর মধ্যে ভুল বোঝার জায়গা কোথায়। বিয়ে কর যদি তো বিয়েই করবে, সোজা কথা।”
“দেখো যতি, মানুষের কোনো কথাটাই সোজা নয়। আমরা ডিক্শনারিতে যে কথার এক মানে বেঁধে দিই, মানবজীবনের মধ্যে মানেটা সাতখানা হয়ে যায়, সমুদ্রের কাছে এসে গঙ্গার মতো।”
যতি বললে, “অর্থাৎ তুমি বলছ বিবাহ মানে বিবাহ নয়।”
“আমি বলছি, বিবাহের হাজারখানা মানে– মানুষের সঙ্গে মিশে তার মানে হয়; মানুষকে বাদ দিয়ে তার মানে বের করতে গেলেই ধাঁধা লাগে।”
“তোমার বিশেষ মানেটাই বলো-না।”
“সংজ্ঞা দিয়ে বলা যায় না, জীবন দিয়ে বলতে হয়। যদি বলি ওর মূল মানেটা ভালোবাসা তা হলেও আর-একটা কথায় গিয়ে পড়ব। ভালোবাসা কথাটা বিবাহ কথার চেয়ে আরো বেশি জ্যান্ত।”
“তা হলে অমিতদা, কথা বন্ধ করতে হয় যে। কথা কাঁধে নিয়ে মানের পিছন পিছন ছুটব, আর মানেটা বাঁয়ে তাড়া করলে ডাইনে আর ডাইনে তাড়া করলে বাঁয়ে মারবে দৌড়, এমন হলে তো কাজ চলে না।”
“ভায়া, মন্দ বল নি। আমার সঙ্গে থেকে তোমার মুখ ফুটেছে। সংসারে কোনোমতে কাজ চালাতেই হবে, তাই কথার নেহাত দরকার। যে-সব সত্যকে কথার মধ্যে কুলোয় না ব্যবহারের হাটে তাদেরই ছাঁটি, কথাটাকেই জাহির করি। উপায় কী। তাতে বোঝাপড়াটা ঠিক না হোক, চোখ বুজে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়।”
“তবে কি আজকের কথাটাকে একেবারেই খতম করতে হবে।”