Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (http://rabindra-rachanabali.nltr.org)


ব্যক্তি প্রসঙ্গ- পরিশিষ্ট,৮৫
পরিশিষ্ট
রামমোহন রায়
২
শিশু মায়ের কোলে বাড়িতে থাকে। প্রত্যেক জাতি তেমনি আপন আপন ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বাড়িয়া থাকে। এইরূপ বৃদ্ধি ও পরিণতির প্রয়োজন আছে। এক সময়ে পৃথিবীর সকল জাতি এইরূপ বিচ্ছিন্নভাবে বাড়িয়াছে। কিন্তু এই বৃদ্ধিই চরম বৃদ্ধি নহে। সকল জাতিকেই বিশ্বের মন্দিরে পূজার অর্ঘ্য যোগাইতে হইবে।

আপনারা শুনিয়াছেন যে ফরাসী রাষ্ট্রবিল্পবের যুগে রামমোহন জন্মলাভ করেন। ওই বিল্পবের যুগে যে বিশ্ববানণী ধ্বনিত হইতেছিল তাহা কেমন করিয়া শিশু রামমোহনের প্রাণ স্পর্শ করে আমরা তাহা বুঝিতে পারি না।

উষার অরুণরশ্মি যেমন উচ্চ শিখরগুলিকে আলোকমণ্ডিত করে, তেমনি সেই যুগে পৃথিবীর কতিপয় মহাত্মা বিশ্ববোধের আলোক লাভ করিয়াছিলেন। শিখরে যখন প্রথম আলোকসম্পাত হয় তখন নিম্নভূমি গভীর অন্ধকারে আবৃত থাকে। বঙ্গভূমি যখন নানা কুসংস্কার ও অজ্ঞানতার গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন তখন বালক রামমোহন অলৌকিক রূপে বিশ্ববোধের আলোক লাভ করিয়াছিলেন। এই জ্ঞানলাভের পক্ষে দেশ অনুকূল ছিল না, বরং সমস্তই তাঁহার প্রতিকূলে ছিল। তিনি যেন দৈবশক্তিবলে এই জ্ঞান লাভ করিলেন।

বঙ্গদেশের এক অখ্যাত অজ্ঞাত প্ললীগ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়া তিনি যে কেমন করিয়া বিশ্ববোধ লাভ করিলেন তাহা বিস্ময়কর। তিনিই এই দেশে তখন ভূমার বাণী ঘোষনা করিতেছিলেন। তিনি বলিয়াছেন—

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।

সেই অন্ধকারের পরপারের মহান্‌ পুরুষকে তিনি জানিয়াছিলেন। অন্ধকারের পরপার হইতে জ্যোতির্ময় পুরুষের আলোক আসিয়া এই শিখরের উপর পতিত হইয়াছিল।

পৃথিবীর কোনো জাতি এখন আপনার সীমার মধ্যে বদ্ধ থাকিতে পারিবে না। উহাতে যে হীন দেশাত্মবোধ জাগাইয়া থাকে তাহা হইতেই হানাহানি-মারামারির সৃষ্টি হয়। এখন প্রত্যেক দেশকে আপন গৃহবাতায়ন খুলিয়া দিয়া বিশ্বকে বরণ করিয়া লইতে হইবে। ছোটো হইয়া থাকায় সুখ নাই, ভমাতেই সুখ।

ভূমৈব সুখম্‌ নাল্পে সুখমস্তি।

পৃথিবীর কোনো জাতি হীনতার মধ্যে চিরকাল থাকিবে না। বাঙালির নিরাশার কারণ নাই। বাঙালির ঘরে রামমোহন জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি বাঙালির ভবিষ্যৎ গৌরব প্রত্যক্ষ করেন। এখন পৃথিবীতে যে রণকোলাহল চলিতেছে ইহারই মধ্যে প্রতিভাশালী ব্যক্তিরা জাতিসমূহের ভবিষ্যৎ ভ্রাতৃসংঘের ছবি প্রত্যক্ষ করিতেছেন, তখন জাতিতে জাতিতে কীরূপ মৈত্রী স্থাপিত হইবে তাহার আলোচনা চলিতেছে।

বঙ্গের ভবিষ্যৎ গৌরব তখনকার গভীর অন্ধকারের মধ্যেই রামমোহন প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন, তিনি বাঙালিকে বিশ্বের রাজপথ দেখাইয়া গিয়াছেন, বাঙালির কোনো নিরাশার কোনো আশঙ্কার কারণ নাই, বাঙালি বৃহৎ মনুষ্যত্বের পথে যাত্রা করিয়াছেন।