
Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (http://rabindra-rachanabali.nltr.org)
ব্যক্তি প্রসঙ্গ- পরিশিষ্ট,৮১
পরিশিষ্ট
লোক, আমরা সমুদ্রের এত কাছে জন্মগ্রহণ করেছি যে নৌকা একটুখানি নদীতে বেয়ে গেলেই সমুদ্রে গিয়ে পড়ি। তাই বুঝতে পারলাম কোনো মহাপুরুষ কেবলমাত্র জন্মাতে পারেন না আঘাত করতে। আমার সেটি মনে হ্ল আমাদের দেশেতে অনাক বড়ো কথা ঋষিরা বলে গিয়েছেন তার মধ্যে সবচাইতে পুরাতন সেই দাঁড়িয়ে যে বলেছিলেন—
যোদেবাগ্নৌ যোহপ্সু যোবিশ্বং ভুবনমাবিবেশ।
যওষধীষু যোবনস্পতিষু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ॥
যিনি সর্বত্র রয়েছেন, যিনি আকাশ বায়ু জলে রয়েছেন, যিনি ঔষধিপত্রপল্লবপূর্ণ বনস্পতিতে রয়েছেন তাঁকে নমস্কার করি।’ কোনো একটা সংস্কারে হৃদয়ে সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত কোনো একটা বিশেষ স্থানে আমাদের ভক্তি আসে। সকল স্থানে আসে না যখন তখনই বুঝতে পারি আমাদের সে শক্তি নাই। সেই সর্বশক্তিমানকে দূরে বলে মানুষ মনে করত। সেই যে মোহ কেটে গেল, তাতে কতখানি একটা চৈতন্য হয়েছে তখন যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই বুঝতে পারেন। এখন বিজ্ঞানের আলোকে দেখা যায় এক শক্তি সর্বত্র। তখন ঋষিরা দিব্যলোকে সর্বত্র সেই শক্তিকে অনুভব ক’রে সকলকে নমস্কার করলেন। সেই রকম আর জিনিস আছে, ইতিহাসে, জাতিতে, ধর্মে, আমরা কত অনৈক্য দেখতে পাই, কিন্তু সব মিলিয়ে একজন রয়েছেন এটা দেখতে বিশেষ চৈতন্য দরকার।
সপর্য্যগাচ্ছুক্রমকাষমব্রণমস্নাবিরং, শুদ্ধমপাপবিদ্ধং।
কবির্ম্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতোর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ॥
যিনি বিধাতা, তিনি বিধান করলেন—তিনি কবি—আনন্দে সমস্ত বিশ্বসংসারে সৃষ্টি করলেন। তিনি মনীষী— মনকে তিনি শাসন করছেন। অব্যাহত তার কবিত্ব প্রকাশ হচ্ছে, তাঁর সৃষ্টিতে, তাঁর ঐশী-শক্তি প্রকাশ করেছেন, সর্বোচ্চ বাণী তিনি জীবনের মধ্য দিয়ে নূতন করে প্রকাশ করেছেন।নববিধান পুরাতনকে নূতন ক’রে গ্রহণ ক’রে প্রকাশ করা। কোনো পুরাতন জিনিসকে নুতন করে যখন কেউ দেখতে চাইবে না, কখনো তাঁরা সে জিনিসে কিছু নূতন দেখতে পারেন না। প্রভাতকাল অতি পুরাতন, দিবা রাত্রি সূর্য চন্দ্র গ্রহমণ্ডল অতি পুরাতন, প্রত্যহ আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু কবি যখন একদিন প্রভাতকে নূতন ভাবে দেখতে পান, তখন তিনি মনে করেন, এ বুঝি কখনো আগে দেখেন নি, এমনটি বুঝি কেউ কখনো দেখে নি। ভারতবর্ষে যে সাধনা করে যে সত্যকে লাভ করেছে আমরা বলব তিনি তা ম্লান করতে দাঁড়িয়েছেন? আমরা বিরোধ দ্বারা কিছুতেই তাঁকে গ্রহণ করতে পারব না। আমরা অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করেছি, সেই সত্যের বিদ্রোহ পতাকা আমরা তুলেছে, যিনি সে সত্যকে প্রচার করতে দাঁড়িয়েছেন তাঁকে আমরা শত্রু বলে মনে করি! গুরুনানক, মহম্মদ প্রভৃতিকেও বিরুদ্ধবাদী বলে মনে করেছি। আমাদের যেটুকু সাধনা সেটুকু নিয়েই আমরা নিজের ধর্মমন্দিরের মধ্যে, নিজের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকি। তাতে আর কারোকে প্রবেশ করিতে দিই না, তা নিয়ে আর কোনো স্থানে যাই না। যিনি সত্যস্বরূপ, তাঁকে সকল ধর্মের মধ্যে প্রকাশ করা, গ্রহণ করা এই কথা সত্য, ব্রহ্মানন্দের মনের কথা এবং তাই নূতন করে তিনি লাভ করে নূতন করে নববিধান বলে প্রকাশ করেছেন। এ যখন বুঝলাম সে বিরোধ আমার ঘুচে গেল, আমি তাই আজ তাঁতে ভক্তি নিবেদন করতে এসেছি।