Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (http://rabindra-rachanabali.nltr.org)


ব্যক্তি প্রসঙ্গ- পরিশিষ্ট,৮০
পরিশিষ্ট
কেশবচন্দ্র সেন
আজকার এই ভক্তের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রকাশের সভায় সভাপতির কার্যের আমি একান্ত অযোগ্য। আজকার সভায় অনেক প্রবীণ ভক্তজন উপস্থিত, যাঁহারা স্বর্গীয় মহাত্মার সঙ্গী ছিলেন, যাঁহাদের ভক্তির সুরে সুর বাঁধিলে ভক্তের গুণগান ভালো শুনাইত; তাঁহাদের উপস্থিতিতে আমার এ কার্যভার গ্রহণ করা একান্তই অযোগ্যপাত্রে ভারার্পণ হইয়াছে। যেমন কখনো কখনো নৌকার মাঝি একজন দাঁড়িকে হাল দিয়া নিজে দাঁড় টানিতে থাকে, তেমনি আজ আমাকে সভাপতির আসন দেওয়া হইয়াছে। আমার নানা অযোগ্যতা সত্ত্বেও কেবল একটি কারণে আমি এ কার্যভার গ্রহনে সম্মত হইয়াছি। পৃথিবীতে জনসমাজের পাপ দুর্গতি নাশের জন্য সাধু মহাত্মারা আসিয়া থাকেন। পরবর্তী সময়ের লোকেরা মনে করে যে আহা আমি যদি সেই সময়ে জন্মগ্রহণ করিতাম তবে সৌভাগ্যবান হইতাম। আমি এই ভক্তের সময়ে জন্মিয়াও তাঁর সঙ্গলাভের সৌভাগ্য লাভ করিতে পারি নাই। তিনি যখন স্বর্গীয় জ্যোতিতে উদ্দীপ্ত হইয়া হিন্দু আত্মীয়গ্ণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হইলেন, এবং আমার পিতৃগৃহে বাস করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন তিনি সদ্যপ্রসূত শিশু। তার পর যখন আমি বালক, কিছু কিছু জ্ঞান হইয়াছে, তখন ব্রাহ্মসমাজে বিরোধের সময়। আমার মনেও সেই বিরোধের ভাব। আমার মনে হইত, তিনি যে ধর্ম, যে সত্য প্রচার করিতেছেন, তাহা আমাদের স্বদেশীয় নয়, বিদেশী। তাঁকে নিয়ে যখন খুব গোলমাল হচ্ছে তখন তাঁর প্রতি আমার একটি বিরোধভাব এসেছিল এটা আমার বেশ মনে আছে। আমারও মনে হয়েছিল তিনি যেন আমার দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। আর আজ দেখছি মহত্ত্বের প্রকাশ বিরোধভাবের মধ্যে দিয়েই হয়ে থাকে। স্বীকার করতে হবে আমার অন্তরের বিরোধভাবের সঞ্চার আমার বালককাল হতেই হয়েছিল। যেমন দেখা যায় ধোঁয়ার প্রাচুর্যবশত আগুনকে দেখা যায় না, আমি তেমনি তখন তাঁর তেজার কিছুই দেখতে পায় নি। যে-সকল মহাপুরুষ আমার জীবনকালের মধ্যেকার, তাঁদের চেনবার আমাদের অবকাশ হয় নি, সেই ভাগ্যহীনতার অবস্থা জীবনে ঘটেছিল এ কথা বলতেই হবে। যে মহাপুরুষের কীর্তি বলতে এসেছি তার সঙ্গে আমাদের যোগ ছিল অথচ কী একটা কুহেলিকা এসেছিল যে তাঁর সঙ্গে সে যোগস্থাপন করতে পারি নি। আজ তাই তাঁর স্মৃতিসভায় তাঁর কাছে ভক্তি নিবাদন করতে এলাম। এজন্যই সভাপতি হওয়া। যাঁরা তাঁর কাছে ছিলেন, তাঁদের কথা বহুমূল্য ও যথার্থ। সে মহাপরুষের কিছু দান করতে আমার আধিকার নাই। আমার এমন কোনো সুযোগ হয় নাই যে কোনো দিন কোনোরকমে তাঁর প্রতি ভক্তি নিবেদন করতে পারতাম, কারণ তাঁর বিষয়ে বলবার, তাঁর সময়কার বিষয় সকল শোনাবার মোটেই কোনো সুযোগ হবার সম্বাবনা নাই, তাই আমি আজ সভাপতি হয়ে তাঁর প্রতি ভক্তি জানাতে সুযোগ নিলাম। তাঁর বিষয়ে যে তখন একটা বিরোধভাব আমার মনে এসেছিল তাঁর একটা কারণও আছে। তখন আমার হত বুঝি আমাদের স্বদেশের যে মাহাত্ম্য আছে, বুঝি সেই মহাপুরুষ সে গৌরবের কিছু ব্যাঘাত করেছেন, বিদেশী সত্যের মাহাত্ম্য বুঝি এত বড়ো করে প্রকাশ করেছেন, তাতে বুঝি আমাদের গৌরব খর্ব করেছেন। তখন বোল ছিল স্বদেশী। এই তখন দম্ভ, দর্প ছিল। একটা ধারণা ছিল আমার, সকলেরই হয়, যে যিনি যে দেশের মহাপুরুষ তিনি সে দেশের বাণী, জ্যোতিঃলাভের কথা বলেছেন তখনই সকলে মনে করেছে ইনি বুঝি বিরুদ্ধবাদী। এ হয়েই থাকে। আর তাঁরা আসেনই সেই সময় যখন আমাদের স্খলন হয়েছে, আমরা যখন ঘোর অন্ধকারে একেবারে তলিয়ে যাচ্ছি— তখনই তাঁরা জন্মগ্রহন করেন— তাই মানুষ বোঝে যেটা আমাদের লোকাচার, এখনকার ধর্ম, ইনি তার বিরুদ্ধে বলেছেন, সাধারণত মানুষ এ কথাই মনে করে। সেই সময় বাইরের আবরণটাকে সরিয়ে ফেলতে চান যাঁরা, তাঁদের তখন বিরুদ্ধবাদী বলে মনে হয়। ভারতবর্ষের অন্তর্নিহিত পুরাতন ঋষিবাক্য উদ্ধার করবার জন্য ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র এসেছিলেন। স্বাদেশিকতার গণ্ডির বাহিরে তাকে অনেকদিন ধরে রেখেছিলাম, কিন্তু তা আর রইল না। আমরা ভারতবর্ষের