আমার কথা শুনে সুকুমার উৎসাহিত হয়ে উঠল ; বললে, আমার শোবার ঘরের জানলা থেকে যে শালগাছটা দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার মাথাটা আমি দেখতে পাই ; মনে হয়, ও স্বপ্ন দেখছে।
শালগাছ স্বপ্ন দেখছে শুনে বোধ হয় বলতে যাচ্ছিলে, কী বোকার মতো কথা। বাধা দিয়ে বলে উঠলুম, শালগাছের সমস্ত জীবনটাই স্বপ্ন। ও স্বপ্নে চলে এসেছে বীজের থেকে অঙ্কুরে, অঙ্কুর থেকে গাছে। পাতাগুলোই তো ওর স্বপ্নে - কওয়া কথা।
সুকুমারকে বললুম, সেদিন যখন সকালবেলায় ঘন মেঘ করে বৃষ্টি হচ্ছিল আমি দেখলুম, তুমি উত্তরের বারান্দায় রেলিঙ ধরে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলে। কী ভাবছিলে বলো দেখি।
সুকুমার বললে, জানি নে তো কী ভাবছিলুম।
আমি বললুম, সেই না - জানা ভাবনায় ভ'রে গিয়েছিল তোমার সমস্ত মন মেঘেভরা আকাশের মতো। সেইরকম গাছগুলো যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ওদের মধ্যে যেন একটা না - জানা ভাব আছে। সেই ভাবনাই বর্ষার মেঘের ছায়ায় নিবিড় হয়, শীতের সকালের রৌদ্রে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেই না - জানা ভাবনার ভাষায় কচি পাতায় ওদের ডালে ডালে বকুনি জাগে, গান ওঠে ফুলের মঞ্জুরিতে।
আজও মনে পড়ে সুকুমারের চোখ দুটো কিরকম এতখানি হয়ে উঠল। সে বললে, আমি যদি গাছ হতে পারতুম তা হলে সেই বকুনি সির্সির্ করে আমার সমস্ত গা বেয়ে উঠত আকাশের মেঘের দিকে।
তুমি দেখলে সুকুমার আসরটা দখল করে নিচ্ছে। ওকে নেপথ্যে সরিয়ে তুমি এলে সামনে। কথা পাড়লে, আচ্ছা, দাদামশায়, এখন যদি সত্যযুগ আসে তুমি কী হতে চাও।
তোমার বিশ্বাস ছিল, আমি ম্যাস্টোডন কিম্বা মেগাথেরিয়ম হতে চাইব — কেননা, জীব - ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়ের প্রাণীদের সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে এর কিছুদিন আগেই আলোচনা করেছি। তখন তরুণ পৃথিবীর হাড় ছিল কাঁচা, পাকা রকম করে জমাট হয়ে ওঠে নি তার মহাদেশ, গাছপালাগুলোর চেহারা ছিল বিশ্বকর্তার প্রথম তুলির টানের। সেইদিনকার আদিম অরণ্যে সেইদিনকার অনিশ্চিত শীতগ্রীষ্মের অধিকারে এই - সব ভীমকায় জন্তুগুলোর জীবযাত্রা চলছে কিরকম করে তা স্পষ্টরূপে কল্পনা করতে পারছে না আজকের দিনের মানুষ, এই কথাটা তোমার শোনা ছিল আমার মুখে। পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম অভিযানের সেই মহাকাব্য - যুগটাকে স্পষ্ট করে জানবার ব্যাকুলতা তুমি আমার কথা থেকে বুঝতে পেরেছিলে। তাই আমি যদি হঠাত বলে উঠতুম ‘সেকালের রোঁয়াওয়ালা চার - দাঁত - ওয়ালা হাতি হওয়া আমার ইচ্ছে' তা হলে তুমি খুশি হতে। তোমার কাবুলি বেড়াল হওয়ার থেকে এই ইচ্ছে বেশি দূরে পড়ত না, আমাকে তোমার দলে পেতে। হয়তো আমার মুখে ঐ ইচ্ছেটাই ব্যক্ত হত। কিন্তু, সুকুমারের কথাটা আমার মনকে টেনে নিয়েছিল অন্য দিকে।
পুপে বলে উঠল, জানি, জানি, সুকুমারদার সঙ্গেই তোমার মনের মিল ছিল বেশি।
আমি বললুম, তার একমাত্র কারণ, ও ছিল ছেলে, আমিও ছেলে হয়েই জন্মেছিলুম একদিন। ওর ভাবনার ছাঁচ ছিল আমারই শিশু ভাবনার ছাঁচে। তুমি সেদিন তোমার খেলার হাঁড়িকুঁড়ি নিয়ে ভাবী গৃহস্থালির যে স্বপ্নলোক বানিয়ে তুলে খুশি হতে সেটা দেখতে পেতুম একটু তফাত থেকে। তুমি তোমার খেলার খোকাকে কোলে করে যখন নাচাতে, তার স্নেহের রসটা ষোলো - আনা পাবার সাধ্য আমার ছিল না।
পুপু বললে, আচ্ছা, সে কথা থাক্, সেদিন তুমি কী হতে ইচ্ছে করেছিলে বলো।