তিনি যে জলদেবী। নারী জাতটা বিশুদ্ধ জলীয় ; তার কাঠিন্য নেই, চাঞ্চল্য আছে, চঞ্চল করেও। ভূব্যবস্থার গোড়াতেই জলরাশি। সেই জলে পানকৌড়ির পিঠে চড়ে যত সব নারী ভেসে বেড়াতে লাগল সারিগান গাইতে গাইতে।
অতি চমৎকার। কিন্তু, তখন পানকৌড়ির সৃষ্টি হয়েছে না কি।
হয়েছে বৈকি। পাখিদের গলাতেই প্রথম সুর বাঁধা চলছিল। দুর্বলতার সঙ্গেই মাধুর্যের অনবচ্ছিন্ন যোগ, এই তত্ত্বটির প্রথম পরীক্ষা হল ঐ দুর্বল জীবগুলির ডানায় এবং কণ্ঠে। একটা কথা বলি, রাগ করবে না তো?
না রাগতে চেষ্টা করব।
যুগান্তরে পিতামহ যখন মানবসমাজে দুর্বলতাকেই মহিমান্বিত করবার কাজে কবিসৃষ্টি করেছিলেন, তখন সেই সৃষ্টির ছাঁচ পেয়েছিলেন এই পাখির থেকেই। সেদিন একটা সাহিত্যসম্মিলন গোছের ব্যাপার হল তাঁর সভামণ্ডপে ; সভাপতিরূপে কবিদের আহ্বান করে বলে দিলেন, তোমরা মনে মনে উড়তে থাকো শূন্যে, আর ছন্দে ছন্দে গান করো বিনা কারণে, যা - কিছু কঠিন তা তরল হয়ে যাক, যা - কিছু বলিষ্ঠ তা এলিয়ে পড়ে যাক আর্দ্র হয়ে। — কবিসম্রাট, আজ পর্যন্ত তুমি তাঁর কথা রক্ষা করে চলেছ।
চলতেই হবে যতদিন না ছাঁচ বদল হয়।
আধুনিক যুগ শুকিয়ে শক্ত হয়ে আসছে, মোমের ছাঁচ আর মিলবেই না। এখন সেদিন নেই যখন নারীদেবতার জলের বাসাটি দোল খেত পদ্মে, যখন মনোহর দুর্বলতায় পৃথিবী ছিল অতলে নিমগ্ন।
সৃষ্টি ঐ মোলায়েমের ছন্দে এসেই থামল না কেন।
গোটা কয়েক যুগ যেতে না যেতেই ধরণীদেবী আর্ত বাক্যে আবেদনপত্র পাঠালেন চতুর্মুখের দরবারে। বললেন, ললনাদের এই লকারবহুল লালিত্য আর তো সহ্য হয় না। স্বয়ং নারীরাই করুণ কল্লোলে ঘোষণা করতে লাগল, ভালো লাগছে না। ঊর্ধ্বলোক থেকে প্রশ্ন এল, কী ভালো লাগছে না। সুকুমারীরা বললে, বলতে পারি নে। — কী চাই। — কী চাই তারও সন্ধান পাচ্ছি নে।
ওদের মধ্যে পাড়াকুঁদুলিরও কি অভিব্যক্তি হয় নি। আগাগোড়াই কি সুবচনীর পালা।
কোঁদলের উপযুক্ত উপলক্ষটি না থাকাতেই বাক্যবাণের টংকার নিমগ্ন রইল অতলে, ঝাঁটার কাঠির অঙ্কুর স্থান পেল না অকূলে।
এত বড়ো দুঃখের সংবাদে চতুর্মুখ লজ্জিত হলেন বোধ করি?
লজ্জা বলে লজ্জা! চার মুণ্ড হেঁট হয়ে গেল। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন রাজহংসের কোটি - যোজন - জোড়া ডানাদুটোর 'পরে পুরো একটা ব্রহ্মযুগ। এ দিকে আদিকালের লোকবিশ্রুত সাধ্বী পরম - পানকৌড়িনী, শুভ্রতায় যিনি ব্রহ্মার পরমহংসের সঙ্গে পাল্লা দেবার সাধনায় হাজার বার করে জলে ডুব দিয়ে দিয়ে চঞ্চুঘর্ষণে পালকগুলোকে ডাঁটাসার করে ফেলছিলেন, তিনি পর্যন্ত বলে উঠলেন, নির্মলতাই যেখানে নিরতিশয় সেখানে শুচিতার সর্বপ্রধান সুখটাই বাদ পড়ে, যথা, পরকে খোঁটা দেওয়া ; শুদ্ধসত্ত্ব হবার মজাটাই থাকে না। প্রার্থনা করলেন, হে দেব, মলিনতা চাই, ভূরিপরিমাণে, অনতিবিলম্বে এবং প্রবল বেগে। বিধি তখন অস্থির হয়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, ভুল হয়েছে, সংশোধন করতে হবে। বাস্ রে, কী গলা। মনে হল মহাদেবের মহাবৃষভটার ঘাড়ে এসে পড়েছে মহাদেবীর মহাসিংহটা — অতিলৌকিক সিংহনাদে আর বৃষগর্জনে মিলে দ্যুলোকের নীলমণিমণ্ডিত ভিতটাতে দিলে ফাটল ধরিয়ে। মজার আশায় বিষ্ণুলোক থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন নারদ। তাঁর ঢেঁকির পিঠ থাবড়িয়ে বললেন, বাবা ঢেঁকি, শুনে রাখো ভাবীলোকের বিশ্ব - বেসুরের আদিমন্ত্র, যথাকালে ঘর ভাঙাবার কাজে লাগবে। ক্ষুব্ধ ব্রহ্মার চার গলার ঐকতান আওয়াজের সঙ্গে যোগ দিলে দিঙ্নাগেরা শুঁড় তুলে, শব্দের ধাক্কায় দিগঙ্গনাদের বেণীবন্ধ খুলে গিয়ে আকাশ আগাগোড়া ঠাসা হয়ে গেল