কাব্যের অবস্থা-পরিবর্তন

য়ুরোপের সাহিত্যে মহাকাব্য লিখিবার কাল চলিয়া গিয়াছে। কোন কবি মহাকাব্য লিখেন না, অনেক পাঠক মহাকাব্য পড়েন না, অনেকে বিদ্যালয়ের পাঠ্য বলিয়া পড়েন, অনেকে কর্তব্য কর্ম বলিয়া পড়েন। অনেক সমালোচক দুঃখ করিতেছেন– এখন আর মহাকাব্য লিখা হয় না, কবিত্বের যুগ চলিয়া গিয়াছে। অনেক পণ্ডিতের মত এই যে, সভ্যতার পাড়ে যতই চর পড়িবে কবিত্বের পাড়ে ততই ভাঙন ধরিবে! প্রমাণ কি? না, সভ্যতার অপরিণত অবস্থায় মহাকাব্য লেখা হইয়াছে, এখন আর মহাকাব্য লেখা হয় না। তাঁহাদের মতে বোধ করি এমন সময় আসিবে, যখন কোন কাব্যই লেখা হইবে না।

সভ্যতার সমস্ত অঙ্গে যেরূপ পরিবর্তন আরম্ভ হইয়াছে কবিতার অঙ্গেও যে সেইরূপ পরিবর্তন হইবে ইহাই সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয়। কবিতা সভ্যতা-ছাড়া একটা আকাশকুসুম নহে। কবিতা নিতান্তই আশ্‌মানদার নয়। তাহার সমস্ত ঘরবাড়িই আশ্‌মানে নহে। তাহার জমিদারিও যথেষ্ট আছে।

সভ্যতার একটা লক্ষণ এই যে, দেশের সভ্য অবস্থায় এক জন ব্যক্তিই সর্বেসর্বা হয় না। দেশ বলিলেই এক জন বা দুই জন বুঝায় না, শাসনতন্ত্র বলিলে একজন বা দুই জন বুঝায় না। ব্যক্তি নামিয়া আসিতেছে ও মণ্ডলী বিস্তৃত হইতেছে। এখন এক জন ব্যক্তিই লক্ষ লোকের সমষ্টি নহে। এখন শাসনতন্ত্র আলোচনা করিতে হইলে একটি রাজার খেয়াল শিক্ষা ও মনোভাব আলোচনা করিলে চলিবে না; এখন অনেকটা দেখিতে হইবে, অনেককে দেখিতে হইবে। এখন যদি তুমি একটা যন্ত্রের একটা অংশ মাত্র দেখিয়া বল যে ‘এ তো খুব অল্প কাজই করিতেছে’, তাহা হইলে তুমি ভ্রমে পড়িবে। সে যন্ত্রের সকল অঙ্গই পর্যবেক্ষণ করিতে হইবে।

এখনকার সভ্য সমাজে দশটাকে মনে মনে তেরিজ কষিয়া একটাতে পরিণত কর। কবিতাও সে নিয়মের বহির্‌ভূত নহে। সভ্য দেশের কবিতা এখন যদি তুমি আলোচনা করিতে চাও তবে একটা কাব্য, একটি কবির দিকে চাহিয়ো না। যদি চাও তো বলিবে “এ কী হইল! এ তো যথেষ্ট হইল না! এ দেশে কি তবে এই কবিতা? “ বিরক্ত হইয়া হয়তো প্রাচীন সাহিত্য অন্বেষণ করিতে যাইবে। যদি মহাভারত কি রামায়ণ কি গ্রীসীয় একটা কোনো মহাকাব্য নজরে পড়ে, তবে বলিবে, “পর্যাপ্ত হইয়াছে! প্রচুর হইয়াছে! ‘ এক মহাভারত বা এক রামায়ণ পড়িলেই তুমি প্রাচীন সাহিত্যের সমস্ত ভাবটি পাইলে। কিন্তু এখন সেদিন গিয়াছে। এখন একখানা কবিতার বইকে আলাদা করিয়া পড়িলে পাঠের অসম্পূর্ণতা থাকিয়া যায়। মনে কর ইংলন্ড। ইংলন্ডে যত কবি আছে সকলকে মিলাইয়া লইয়া এক বলিয়া ধরিতে হইবে। ইংলন্ডে যে কবিতা-পাঠক-শ্রেণী আছেন, তাঁহাদের হৃদয়ের এক-একটা মহাকাব্য রচিত হইতেছে। তাঁহারা বিভিন্ন কবির বিভিন্ন কাব্যগুলি মনের মধ্যে একত্রে বাঁধাইয়া রাখিতেছেন। ইংলণ্ডের সাহিত্যে মানবহৃদয়-নামক একটা বিশাল মহাকাব্য রচিত হইতেছে, অনেকদিন হইতে অনেক কবি তাহার একটু একটু করিয়া লিখিয়া আসিতেছেন। পাঠকেরাই এই মহাকাব্যের বেদব্যাস। তাঁহারা মনের মধ্যে সংগ্রহ করিয়া সন্নিবেশ করিয়া তাহাকে একত্রে পরিণত করিতেছেন। যে কেহ ইহার একটি মাত্র অংশ দেখেন অথবা সকল অংশগুলিকে আলাদা করিয়া দেখেন, তিনি নিতান্ত ভ্রমে পড়েন। তিনি বলেন, সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে কাব্য অগ্রসর হইতেছে না। তিনি কী করেন, না, একটি সাধারণতন্ত্রের শাসনপ্রণালীর প্রতিনিধিগণের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করিয়া দেখেন। দেখেন রাজার মতো প্রভূত ক্ষমতা কাহারও হস্তে নাই, রাজার মতো একাধিপত্য কেহ করিতে পায় না, ও তৎক্ষণাৎ এই সিদ্ধান্ত করিয়া বসেন যে, “দেশের রাজ্যপ্রণালী ক্রমশই অবনত হইয়া আসিতেছে। সভ্যতা বাড়িতেছে বটে কিন্তু রাজতন্ত্রের উন্নতি কিছুই দেখিতে পাইতেছি না। বরঞ্চ উল্টা!” কিন্তু সভ্যতা বাড়িতেছে বলিলেই বুঝায় যে, জ্ঞানও বাড়িতেছে, কবিতাও বাড়িতেছে।