বস্তুগত ও ভাবগত কবিতা

চারি দিকে লোক জন, চারি দিকেই হাট বাজার, সদাসর্বদাই কাজকর্ম বিষয়আশয়ের চিন্তা। সম্মুখে দেনাদার, পশ্চাতে পাওনাদার, দক্ষিণে বিষয়কর্ম, বামে লোকলৌকিকতা, পদতলে গত কল্যের খরচ, মাথার উপরে আগামী কল্যের জন্য জমা। যে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি– পৃথিবীর মৃত্তিকা; দীর্ঘ, প্রস্থ, বেধ; স্বাদ, ঘ্রাণ, স্পর্শ; আরম্ভ, স্থিতি ও অবসান। মানুষের মন কোথায় গিয়া বিশ্রাম করিবে? এমন ঠাঁই কোথায় মিলিবে, যেখানে জড়দেহপোষণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা নাই, এক-মুঠা আহারের জন্য লক্ষ লক্ষ আকৃতিধারীর কোলাহল নাই, যেখানকার ভূমি ও অধিবাসী মাটি ও মাংসে নির্ম্মিত নয়; অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টা আমরা যে অবস্থার মধ্যে নিমগ্ন থাকি সে অবস্থা হইতে আমরা বিরাম চাই। কোথায় যাইব!

পৃথিবী কিছু বিশ্রামের জন্য নহে, পৃথিবীর পদে পদে অভাব। পৃথিবীর উপরে চলিতে গেলে মৃত্তিকার সহিত সংগ্রাম করিতে হয়, পৃথিবীর উপরে বাঁচিতে গেলে শত প্রকার আয়োজন করিতে হয়। যাহার আকার আছে তাহার বিশ্রাম নাই। আমাদের হৃদয় আকার-আয়তন-ছাড়া স্থানে বিশ্রামের জন্য যাইতে চায়। বস্তুর রাজ্য হইতে ভাবের রাজ্যে যাইতে চায়। কেবল বস্তু! দিন রাত্রি বস্তু, বস্তু, বস্তু! হৃদয় ভাবের আকাশে গিয়া বলে, “আঃ, বাঁচিলাম, আমার বিচরণের স্থান তো এই! “

এমন লোকও আছেন যাঁহারা ভাবিয়া পান না যে, ভাবগত কবিতা বস্তুগত কবিতা অপেক্ষা কেন উচ্চ শ্রেণীর। তাঁহারা বলেন ইহাও ভালো উহাও ভালো। আবার এমন লোকও আছেন যাঁহারা বস্তুগত কবিতা অধিকতর উপভোগ করেন। উক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সুরুচিবান্‌ লোকদের আমরা জিজ্ঞাসা করি যে, ইন্দ্রিয়সুখ ভালো না অতীন্দ্রিয় সুখ ভালো? রূপ ভালো না গুণ ভালো? ভাবগত কবিতা আর কিছুই নহে, তাহা অতীন্দ্রিয় কবিতা। তাহা ব্যতীত অন্য সমুদয় কবিতা ইন্দ্রিয়গত কবিতা।

আমরা সমুদ্রতীরবাসী লোক। সম্মুখে চাহিয়া দেখি– সীমা নাই! পদতলে চাহিয়া দেখি – সেইখানেই সীমার আরম্ভ। আমরা যে উপকূলে দাঁড়াইয়া আছি তাহাই বস্তু, তাহাই ইন্দ্রিয়। তাহার চতুর্দিকে ভাষার অনধিগম্য সমুদ্র। এ ক্ষুদ্র উপকূলে আমাদের হৃদয়ের বাসস্থান নয়। যখন কাজকর্ম সমাপ্ত করিয়া সন্ধ্যাবেলা এই সমুদ্রের তীরে আসিয়া দাঁড়াই, তখন মনে হয়, যেন ঐ সমুদ্রের পরপারে কোথায় আমাদের জন্মভূমি– কে জানে কোথায়? ঐ-যে দূর দিগন্তে সূর্যের মৃদু রশ্মিরেখা দেখা যাইতেছে, তাহা যেন আমাদের জন্মভূমির দিক হইতে আসিতেছে। সে জন্মভূমির সকল কথা ভুলিয়া গেছি, অথচ তাহার ভাবটা মাত্র মনে আছে– অতি স্বপ্নময়, অতি অস্ফুট ভাব। ইচ্ছা করে ঐ সমুদ্রে সাঁতার দিই, সেই দূর দ্বীপ হইতে বাতাস ধীরে ধীরে আসিয়া আমাদের গাত্র স্পর্শ করে, সেই দূর দিগন্তের অস্ফুট সূর্যকিরণের দিকে আমাদের নেত্র থাকে, আর আমাদের পশ্চাতে এই ধূলিময় কীটময় কোলাহলময় উপকূল পড়িয়া থাকে। সাঁতার দিতে দিতে মনে হয় যেন পশ্চাতের উপকূল আর দেখা যাইতেছে না ও সম্মুখে সেই দূর দেশের তটরেখা যেন এক-একবার দেখা যাইতেছে ও আবার মিলাইয়া যাইতেছে। সমস্তদিন কাজকর্ম করিয়া আমরা বিশ্রামের জন্য কোথায় আসিব? এই সমুদ্রকূলেই কি নহে? সমস্তদিন দোকান বাজারের মধ্যে, রাস্তা গলির মধ্যে থাকিয়া, দুই দণ্ড কি মুক্ত বায়ু সেবন করিতে আসিব না? আমরা জানি যে, যেখানে সীমা আরম্ভ সেইখানেই আমাদের কাজকর্ম যুঝাযুঝি ও অসীমের দিকে আমাদের বিশ্রামের স্থল আছে– সেই দিকেই কি আমরা মাঝে মাঝে নেত্র ফিরাইব না? সে অসীমের দিকে চাহিলে যে অবিমিশ্রিত সুখ হয় তাহা নহে, কোমল বিষাদ মনে আসে। কারণ, সে দিকে চাহিলে আমাদের ক্ষুদ্রতা আমাদের অসম্পূর্ণতা চোখে পড়ে, সংশয়ান্ধকারে আচ্ছন্ন প্রকাণ্ড রহস্যের মধ্যে নিজেকে রহস্য বলিয়া বোধ হয়– সে রহস্য ভেদ করিতে গিয়া হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসি। সমুদ্রে সাঁতার দিতে ইচ্ছা হয়, অথচ তাহা আমাদের সাধ্যের অতীত! অনেক উপকূলবাসী চিরজীবন এই উপকূলের